২০২০ সাল পড়ার আগেই বিশ্বে অল্পবিস্তর করোনা ভাইরাসের কথা জানা যাচ্ছিল। তখনও পর্যন্ত তা চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল যদিও। তার পরবর্তী পর্যায়ের কথা তো সবাই জানেন! আমরা কথায় কথায় বলে থাকি এরপর কি ঘটেছে তা ইতিহাস হয়ে যাবে। কিন্তু না, ২০২০ সাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটে চলেছে তার মতো কঠিন বাস্তব অতীতে আর কিছু ঘটেছে বলে মনে হয় না!
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ স্বাস্থ্য ক্ষেত্র ছাড়িয়ে অর্থনীতিতে গিয়ে এমন এক জোরদার ধাক্কা মেরেছে যার ফলে গোটা বিশ্বেই মানুষজনকে টিকে থাকার লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। অসংখ্য মানুষের কাজকর্ম চলে গিয়ে কি করে জীবন ধারন করবে তাই হয়ে উঠেছে মূল ভাবনা। কিন্তু এই প্রভাব শুধুমাত্র স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এ গিয়ে সরাসরি ধাক্কা মেরেছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি এবং রাজনিতীতেও।
এই বছর করোনা ভাইরাসের প্রত্যক্ষ প্রভাব বা পরোক্ষ প্রভাবে একাধিক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে। আমরা এরকমই পাঁচটি অতিগুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উপর নজর রাখব, যে রাজনৈতিক ঘটনাগুলির প্রভাব জনজীবনে বিপুল সেগুলিই মূলত আমাদের আলোচ্য প্রক্রিয়ার অংশ হবে।
১) আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে মূল কোন বিষয়গুলি মেনে চলতে হবে সবাইকে, এটা বোধহয় আজ আর কোনো মানুষের অজানা নয়। স্বাভাবিকভাবেই দুটো দেশের মধ্যে যখন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয় বা যুদ্ধ চলে তখন এই শারীরিক দূরত্ব তো দূরের কথা, মাস্ক পড়ে থাকাও সম্ভব নয়।
অথচ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের এই অতি জরুরী পরিস্থিতিও এই দুটি দেশের চিরাচরিত বৈরিতাকে রুখে দিতে অক্ষম হলো, যা প্রমাণ করলো আমাদের ভেতরের হিংসা এবং জিঘাংসার মনোভাব কোনো কিছুর দ্বারাই দমিয়ে রাখা যায় না। আর তা যদি হয় তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সম্মানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাহলে তো কথাই নেই, রে রে করে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো এটাই স্বাভাবিক।
মুসলিম প্রধান আজারবাইজানের অভ্যন্তরে আর্মেনীয় অধ্যুষিত নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চলটিকে কেন্দ্র করে ‘আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র’ গড়ে উঠেছে। যদিও এটির অস্তিত্ব যেমন আজেরবাইজান মেনে নেয় না তেমনই রাষ্ট্রসংঘ সহ বিশ্বের কোনো স্বাধীন দেশ এই প্রজাতন্ত্রকে স্বীকার করে নেয় নি। তবুও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এই প্রজাতন্ত্র নিজের যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ করে থাকে। জাতীয়তাবাদের স্বাভাবিক নিয়মে আর্মেনিয়া সমস্ত ক্ষেত্রে আর্টসাখ প্রজাতন্ত্রকে মদত যুগিয়েছে। এমনকি যেকোনো প্রয়োজনেই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ প্রতিরক্ষামূলক সহায়তা করে থাকে আর্মেনিয়া।
এর আগে যতগুলো আর্মেনিয়া ও আজেরবাইজন যুদ্ধ হয়েছে প্রতিটিতেই জয়লাভ করেছে আর্মেনিয়া। এবারে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম থেকেই তীব্র হয়ে ওঠে আর্মেনিয়া আজেরবাইজান দ্বন্দ্ব। সরাসরি পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দু’পক্ষের মধ্যে। দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাস ধরে যুদ্ধ চলার পর রাশিয়ার মধ্যস্থতায় এই দুই প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
আপাতত ককেশাস অঞ্চলে শান্তি ফিরে এলেও এই যুদ্ধের তাৎপর্য অনেক। মূলত এই যুদ্ধ প্রতিষ্ঠা করে দিলো অতীতের যাবতীয় দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে আজেরবাইজান এক শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে এই যুদ্ধপরবর্তী চুক্তি আর্টসাখ প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি করেছে। একই সঙ্গে এই যুদ্ধ বুঝিয়ে দিল ককেশাস অঞ্চলে বড়োসড়ো কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে তুরস্ক সরাসরি আজারবাইজানের পক্ষ অবলম্বন করবে। সেক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে রাশিয়াকে আর্মেনিয়ার পক্ষ নিতে হবে, যা ভয়ানক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে ওই অঞ্চলকে।
২) নিউজিল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল
এই বছর মহামারীর মধ্যেই ১৭ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নিউজিল্যান্ডে। ফল প্রকাশ পেলে দেখা যায় বাম ঘেঁষা লেবার পার্টি সেই দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর সংস্কারের পর প্রথমবারের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছে। জেসিন্ডা আরডার্নের নেতৃত্বাধীন শাসকদল পার্লামেন্টের ১২০ টি আসনের মধ্যে ৬৫ টিতেই বিজয়ী হয়।
নিউজিল্যান্ড বাসী জেসিন্ডা আরডার্নের ওপর আস্থা রেখে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কারণ বেশ কয়েক বছর ধরেই গোটা বিশ্ব জুড়ে দেখা যাচ্ছিল দক্ষিণ পন্থার রমরমা। বোঝা যাচ্ছিল বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই হয়তো উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় বিভেদের নীতিতে আস্থাশীল হয়ে উঠেছে। অথচ নিউজিল্যান্ডের এই ভোটের ফল প্রমাণ করলো সেখানকার বাসিন্দারা উদারচেতা মনোভাব এবং মানবিক বোধ ও সহমর্মিতার প্রতি একই রকম আস্থাশীল আছে। নিউজিল্যান্ডের এই দৃষ্টান্ত শান্তিকামী এবং প্রগতিশীল মানুষদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে।
৩) আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যেকের জানা। আমরা প্রত্যেকেই জানি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পপুলার ভোট এবং ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে পরাজিত করে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তিনি আগামী বছর ২৪ জানুয়ারি দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন।
ট্রাম্পের পরাজয় যেমন উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং জাতিবিদ্বেষী মনোভাবের পরাজয়, তেমনি এটাও মাথায় রাখতে হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি সেই দেশের ৭ কোটিরও বেশি মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। এই তথ্য থেকে খুব ভালোভাবেই বোঝে যাচ্ছে পৃথিবীর পাওয়ার হাউস বলে পরিচিত আমেরিকার সমাজ সম্পূর্ণভাবে দুই মেরুতে বিভক্ত। যতই ট্রাম্পের বদলে বাইডেন সেখানকার ক্ষমতায় আসুক না কেন, মার্কিনিদের মধ্যে থেকে জাতি বিদ্বেষী মনোভাব এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা সহজে যাওয়ার নয়। আমরা আশাবাদী মানুষ বলে ‘সহজে যাওয়ার নয়’ কথাটি ব্যবহার করলাম, কিন্তু তা যে আদৌ কোনো দিন যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে! তবে এই নির্বাচনী ফলাফল পৃথিবীর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এবং পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সত্যিই নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
৪) শৈশবেই বিপন্ন নেপালের গণতন্ত্র
দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সামলে এবং রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মতোই গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করেছিল নেপাল। কিন্তু সেই দেশের শাসক দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নেপালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যাবতীয় নিয়ম-নীতি অগ্রাহ্য করে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী খর্গ প্রসাদ শর্মা ওলি পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেন এবং রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভান্ডারী তা মেনে নিয়ে নতুন করে নির্বাচনের কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন।
নেপালের গণতন্ত্র বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া নিয়েই এই ঘটনা থেমে থাকেনি। এই ঘটনাকে হাতিয়ার করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়ে চীন প্রত্যক্ষভাবে সেই দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাক গলাতে শুরু করেছে। এমনকি পরবর্তী পর্যায়ে নেপালের শাসনক্ষমতায় কোন নেতা বসবেন, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি এক হয়ে থাকবে না কি তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে, এই সমস্ত কিছুতেই খবরদারি করতে শুরু করেছে চীন। যা ভারতের কাছে অশনি সংকেতের সমান।
৫) ইসরায়েল নিয়ে আরব দেশগুলির মত পরিবর্তন
মধ্যপ্রাচ্যে আরব ভূমি প্যালেস্টাইনের জায়গা দখল করে ইহুদিবাদী ইসরায়েল গড়ে ওঠার ঘটনা কোনোদিনই স্বাভাবিক মনে মেনে নিতে পারেনি বাকি আরব রাষ্ট্রগুলি। এই নিয়ে তিন তিনটি আরব ইসরায়েল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যদিও সবগুলিতেই ঈসরায়েল জয়লাভ করে। বর্তমানে তারা প্যালেস্তাইনের ক্ষেত্রে ক্রমশ সাম্রাজ্যবাদী নীতি নিয়ে চলেছে। প্যালেস্টাইনের অন্তর্গত ওয়েস্ট ব্যাংক অঞ্চলেও নিজেদের বসতি স্থাপন করা শুরু করেছে এই রাষ্ট্রটি।
এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ বিশ্ব রাজনীতিকে অবাক করে দিয়ে এই বছরেই সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ইসরায়েলের সঙ্গে প্রথমবারের মতো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই এই ধারা অনুসরণ করে আরেক আরব রাষ্ট্র বাহরিন ইসরাইলের সঙ্গে একই রকমভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে অবাক করা কান্ড ঘটে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বরাবরের সরব সৌদি আরব তাদের আকাশ সীমা ইসরায়েলি বিমান সংস্থাগুলির জন্য খুলে দেওয়ায়! তারা জানিয়ে দেয় ইসরায়েল থেকে আরব আমিরশাহী যাওয়া বিমানগুলি তাদের আকাশপথ ব্যবহার করতে পারবে।
একের পর এক আরব রাষ্ট্রের এই ভোলবদল প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ করে তোলে। সেখানকার রাষ্ট্রপতি মেহমুদ আব্বাস এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এই ঘটনা থেকে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে সময়ের নিয়ম মেনে আরব রাষ্ট্রগুলি একে একে জাতিগত দ্বন্দ্বে ভুলে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে।
তবে কেবলমাত্র এই পাঁচটি ঘটনাই নয়, বিশ্ব রাজনীতিতে আরো অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই বছর ঘটে গিয়েছে। যেমন নারীবাদী আন্দোলনের কর্মীদের অবাক করে কুয়েতের সংসদ নির্বাচনে এবারে জয়লাভ করতে ব্যর্থ হন নারী প্রার্থীরা। তার ফলে দীর্ঘ ১০ বছর পর কুয়েতের সংসদ নারী বিহীন হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত আরব দেশগুলির মধ্যে কুয়েতকেই তুলনায় প্রগতিশীল বলে মনে করা হয়। এই বছরেই হযরত মোহাম্মদের কার্টুন ইস্যুকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স এবং তুরস্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রবল হয়ে উঠেছে।
এরকম একাধিক ঘটনা বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঘটেছে এবং আগামী বছরও আরো অনেক কিছু ঘটবে। সেটাই স্বাভাবিক। তবু আমরা আশা রাখবো আগামী দিনে বিশ্বরাজনীতিতে যা যা ঘটবে সবই প্রগতিশীলতার পক্ষে ঘটবে। হানাহানি হিংসা বিদ্বেষ যেন বিশ্ব রাজনীতিকে আর কলুষিত না করে!