মতুয়া ধর্মের প্রচার শুরু হয় বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলা থেকে। গোপালগঞ্জের সফলাডাঙ্গা গ্রামে জন্মেছিলেন মতুয়া মতবাদের আদি পুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর। তাকে মতুয়ারা শ্রীচৈতন্যের অবতার মনে করেন। সমাজের নমশূদ্র বৈষ্ণব পরিবারে তার জন্ম হলেও তিনি প্রেম ও ভক্তির রসের এই নতুন মতবাদ প্রচার করেন। তথাকথিত হিন্দু ধর্মের থেকে এই মতবাদের মূল পার্থক্য হল এনারা একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করেন। সেইসঙ্গে মনে করেন ভক্তি এবং নাম সংকীর্তনের মধ্যে দিয়েই ঈশ্বরের দেখা পাওয়া সম্ভব। আরেকটি বড় পার্থক্য হল এই মতবাদে সন্ন্যাসী জীবনযাপনের আলাদা কোনো জায়গা নেই। গার্হস্থ্য জীবন পালন করে ঈশ্বরের দেখা পাওয়া সম্ভব বলেই মনে করেন মতুয়ারা।

images 13 5
Facebook

নমশূদ্র পরিবারের মধ্য থেকে এই মতবাদের জন্ম হওয়া স্বাভাবিক ভাবেই সেই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই মত বাদের প্রসার সবচেয়ে বেশী। হরিচাঁদ ঠাকুরের পর তার পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়াদের আর্থসামাজিক উন্নতির লক্ষ্যে শিক্ষার প্রসারের ওপর প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করেন। সেই তখন থেকেই মতুয়া সম্প্রদায়ের বিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতাকেই মূল মানদন্ড করা হয়ে থাকে। গুরুচাঁদ ঠাকুরকে মতুয়ারা স্বয়ং শিবের অবতার বলে মনে করেন। সমাজ সংস্কার ঘটিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর বিধবা বিবাহের প্রতি সমর্থন  জানিয়েছিলেন এবং একইসঙ্গে বাল্যবিবাহের তীব্র বিরোধিতা করেন।

মতুয়া ধর্মের মূল পীঠস্থানটি বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে হরিচাঁদ ঠাকুরের নাতি পি আর ঠাকুর বাংলাদেশ থেকে চলে এসে উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগর অঞ্চলে থাকতে শুরু করেন। কালক্রমে ঠাকুরনগর হয়ে ওঠে মতুয়া সম্প্রদায়ের মূল পরিচালন ক্ষেত্র। দেশ বিভাজন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ গড়ে ওঠার ফলে মতুয়া সম্প্রদায় ভুক্ত বেশিরভাগ মানুষ ভারতে চলে আসেন। তাদের বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গে বাসস্থান গড়ে তুললেও ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলিতেও ভালো পরিমাণে মতুয়া সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষের বসবাস আছে।

images 14 5
www.anandabazar.com

মতুয়ারা কখনোই একসঙ্গে পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে আসে নি। ধাপে ধাপে ভারতে আসার পর তারা এই দেশেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মূল দাবি হয়ে দাঁড়ায় দেশের নাগরিকত্ব। এক বড় অংশের মতুয়া সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষ ইতিমধ্যেই দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে গেলেও অনেকেই এখনও তা পায়নি। বিশেষত বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যারা এপার বাংলায় এসেছেন কেন্দ্রীয় আইন মেনে তাদের অনেককেই অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে তাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ আরো জটিল হয়ে উঠেছে।

নাগরিকত্ব লাভের জন্য মতুয়ারা নানা সময়ে নানান রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের সমর্থন জানায়। বামফ্রন্ট ১৯৭৭ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর তারা বামেদের পক্ষেই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় না থাকার দরুন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাম নেতৃত্ব খুব একটা কাজের কাজ কিছু করে উঠতে পারেনি। পরবর্তীতে মতুয়াদের নাগরিকত্ব সহ যাবতীয় সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়ে তাদের সমর্থনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার ফলশ্রুতিতে ২০১১ এর বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়ারা ঢেলে ভোট দেয় তৃণমূলকে।

এরপর বিজেপি এনআরসি ও সিএএ আইন আনার মধ্য দিয়ে মতুয়াদের বার্তা দেয় তারাই তাদের নাগরিকত্ব দেবে। এই কথায় বিশ্বাস করে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে মতুয়ারা তৃণমূলের পাশ থেকে সরে গিয়ে বিজেপির প্রতি সমর্থন জানায়। যার ফলে মতুয়া প্রভাবিত একাধিক লোকসভা কেন্দ্রে জয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল বিজেপি। যদিও তারপর এনআরসি বিরোধী দেশজোড়া আন্দোলনের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ওই আইন এখনো পর্যন্ত কার্যকারী করে তুলতে পারেনি। যার ফলস্বরূপ মতুয়াদের নাগরিকত্ব লাভের স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই থেকে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মতুয়া সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষদের মনে বিজেপির প্রতি যে আস্থা ছিল তা ক্রমশ ফিকে হতে শুরু করেছে।

images 15 8
Kolkata tv

ঠিক এরকমই একটা প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে মতুয়া সমর্থন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অন্যতম নির্ধারক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছে মতুয়া সমর্থন যাদের দিকে যাবে তারাই রাজ্যের ক্ষমতা দখলের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। কিন্তু কেন মতুয়াদের সমর্থন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নির্ধারক শক্তি তা আমরা আলোচনা করব এখন।

• ২১ এর ভোটে মতুয়া সমর্থন কেন ফ্যাক্টর?

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়া জেলায় একচেটিয়া বসবাস করে মতুয়ারা। তারমধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ মহকুমা সম্পূর্ণভাবে মতুয়া অধ্যুষিত। এছাড়াও এই জেলার বারাসাত, মধ্যমগ্রাম, রাজারহাটের মতো শহরাঞ্চল গুলিতেও মতুয়া ধর্ম বিশ্বাসী মানুষদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই রাজ্যে মতুয়া ভোটারের সংখ্যা প্রায় পৌনে দুই কোটি। এই হিসাব থেকেই পরিষ্কার মতুয়া ভোট যেদিকে যাবে সেই দল রাজ্যের গদি দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে যাবে। বিভিন্ন হিসাব কষে দেখা গিয়েছে রাজ্যের প্রায় ৩০ টি বিধানসভা কেন্দ্রের জয়-পরাজয় নির্ভর করে মতুয়াদের সমর্থনের ওপর। এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু কেন্দ্রে মতুয়ারা মূল ফ্যাক্টর না হলেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

তৃণমূলের কাছে মতুয়া সমর্থন এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হিন্দুর সাম্প্রদায়িক নীতির মোকাবিলা করতে গেলে রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটকে পুরোটাই নিজেদের দিকে আনা দরকার ছিল তৃণমূলের পক্ষে। কিন্তু ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী এবং হায়দ্রাবাদের সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসির মিম পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ঘোষণা করায় সংখ্যালঘু ভোটে বিভাজন যে ঘটবে তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে। সেইসঙ্গে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোট হলে তারাও ভালো পরিমাণে সংখ্যালঘু ভোট নিজেদের দখলে নিয়ে নেবে বলেই মনে হয়।

তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক এইভাবে বিভাজিত হয়ে যাওয়ার পর মতুয়াদের সমর্থন‌ই একমাত্র তাদের রক্ষা করতে পারে। কিন্তু বিজেপি মাস্টার স্ট্রোক দিয়ে ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের মতো বেশিরভাগ মতুয়ার সমর্থন যদি পদ্মফুলের দিকেই ঘুরিয়ে নিতে সক্ষম হয়, তাহলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তাদের বিপদ যে অবশ্যম্ভাবী তৃণমূল নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই তা বুঝে গিয়েছে। কারণ গত লোকসভা নির্বাচনে মতুয়াদের সমর্থন বিজেপির দিকে ছিল বলেই মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁ এবং রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্র তৃণমূলের থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল গেরুয়া শিবির।

মতুয়া,
OneIndia Bengali

বিজেপির কাছে মতুয়া সমর্থন এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

২০১৯ এর লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে তাদের সাফল্যের পর বিজেপি নেতৃত্ব এই রাজ্যের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে অনেকটাই পার্থক্য থেকে যায়। বিজেপি যতই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করুক, এই রাজ্যের হিন্দু সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষদের একাংশ বিজেপিকে এখনো পর্যন্ত পছন্দ করেনা তাদের কট্টর ধর্মীয় নীতির জন্য। সেইসঙ্গে দার্জিলিং পাহাড় এবং ডুয়ার্সে তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী বিমল গুরুং হাতছাড়া হওয়ায় ওই অঞ্চলে ভালো ফল করা বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে বেশ কঠিন। একই রকম ভাবে এই রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো সমর্থন‌ও তারা প্রায় পাবে না।

এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করতে গেলে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়া প্রভাবিত কেন্দ্রগুলিতে ভালো ফলাফল করা বিজেপির পক্ষে খুবই জরুরী। সে ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত যত দ্রুত সম্ভব মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রদান করে তাদের সমর্থনকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসা।

মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিরা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন যারা তাদের নাগরিকত্ব প্রদান করবে তারা তাদেরকেই আগামী বিধানসভা নির্বাচনে সমর্থন করবে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে যেহেতু নাগরিকত্ব প্রদান করা সম্ভব নয় সেতু বিষয়টি গিয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপি প্রতিশ্রুতি মত তাদের নাগরিকত্ব প্রদান করতে সক্ষম হলো নাকি ব্যর্থ হলো। বিজেপি যদি নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় সে ক্ষেত্রে প্রতিশোধ নিতে মতুয়ারা ঢেলে তৃণমূল প্রার্থীদের ভোট দেবেন। আর যদি বিজেপি নাগরিকত্বের প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা বজায় রাখতে পারে বা নিদেনপক্ষে সেই প্রক্রিয়া শুরু করে দিতে পারে তাহলে তৃণমূলের পক্ষে নবান্নের ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন নয় অসম্ভব প্রায়।