সে একটা সময় ছিল। যখন বাংলা আজ যা ভাবত, ভারতবর্ষ তা ভাবত কাল। শিক্ষায়, চেতনায়, জাত্যাভিমানে যুগপুরুষদের জন্ম দিয়েছিল বাংলা। ঋষি অরবিন্দ, মেঘনাদ সাহা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, রমেশ্চন্দ্র মজুমদার – বাঙালি বুদ্ধিজীবীর লিস্ট অনেক লম্বা। সে রাম আর নেই। নেই সে অযোধ্যাও। তবু সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের স্বর্ণযুগের ছোঁয়া ধরে রেখেই এগিয়েছে একবিংশ শতাব্দীর বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহল।

বুদ্ধিজীবী কাকে বলে? সে এক বিতর্কিত বিষয়। কোন কোন মাপকাঠিতে পাশ করলে কাউকে বুদ্ধিজীবী বলা যায়, তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করা যায়, মীমাংসায় পৌঁছনো যায় না। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, সাধারণ মানুষের উপর বুদ্ধিজীবীদের প্রভাব অপরিসীম এবং তাঁরা জনমত তৈরি করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গেই তার উদাহরণ রয়েছে।

২০১০-১১ সালে বাম শাসনের সময়ে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৩৪ বছরের বাম শাসনে মানুষ বুঝতে শুরু করেছিলেন যে বামেরা অপরিহার্য। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা পরিবর্তন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পুরোভাগে ছিলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কবি জয় গোস্বামী, অভিনেত্রী-পরিচালিকা অপর্ণা সেন, কৌশিক সেন, চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন, নাট্যকার ব্রাত্য বসু, কবি সুবোধ সরকার প্রমুখ। এঁরা মানুষকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে জনগণ চাইলেই পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

এই বুদ্ধিজীবীরা প্রত্যেকেই প্রায় বাম মনস্ক। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই কেন, সারা ভারতবর্ষেই বুদ্ধিজীবী মহল বামচিন্তাধারায় বিশ্বাসী সেটা স্পষ্ট। সে রামচন্দ্র গুহই হন কিংবা রাহুল সংস্কৃত্যায়ন। এই জায়গাতেই চিন্তার সংকট তৈরি হয়। বিশেষ করে যখন কোনও রাজনৈতিক দল দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে চায়। কারণ জনমানসে ছাপ ফেলতে বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন জরুরী। ফলে বিজেপি চাইছে নিজেদের বুদ্ধজীবী সেল। গোটা ভারতে এবং এই বাংলাতেও।

বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সত্যি। ফলে গেরুয়া শিবির চাইছে নতুন মুখ। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয়। চাইলেই বুদ্ধিজীবী পয়দা করা যায় না। ফলে পুরনো বোতলে নতুন মদ। এখানে দেখে নেওয়া যাক বিজেপির রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার সঙ্গে নিজেদের বৈচারিক জ্ঞানের মিশেলে গেরুয়া শিবিরের হয়ে জনগণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে কাদের? কারাই বা এই মুহূর্তে বিজেপির হয়ে ইনিংস খেলছেন? গেরুয়া শিবিরের বুদ্ধিজীবী কারা? নজরে ৫ পয়েন্টে –

913937 uvthofowye 1533102062

১। তথাগত রায় – সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই অ্যাকটিভ। অধিকাংশ সময়ই খড়্গহস্ত থাকেন। ফলে বিতর্কেও জড়ান। বামপন্থী এবং তৃণমূলীদের যুক্তি কচুকাটা করতে সিদ্ধহস্ত। বিজেপির রাজ্য সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন একসময়। তবে দলকে লাভের গুড় খাওয়াতে পারেননি। মেঘালয়ের রাজ্যপাল হন। অবসর নিয়ে বঙ্গে ফিরে নিজেই নিজেকে বিজেপির মুখমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে পেশ করেছেন।

58381935 108841456988423 2160553169057218560 n

২। রন্তিদেব সেনগুপ্ত – রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সদস্য। সেই সূত্রেই বিজেপিতে আসা। ২০১৯ লোকসভা ভোটে হাওড়া সদর কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন। পরাজিত হন। পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। বেশ কিছু বইও লিখেছেন। সাংবাদিক জীবন থেকেই হিন্দুত্ববাদের সমর্থনে কলম ধরেছেন। বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-সহ নানা পোর্টাল, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপির হয়ে ব্যাটিং করেন।

Mohit Kumar Ray Kolkata 2012 05 19 3139

৩। মোহিত রায় – মানবিধকার কর্মী হিসাবেই তাঁর নামডাক। পরিবেশ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মীও তিনি। আদি গঙ্গা এবং বিক্রমগড় ঝিল পুনরুদ্ধার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন মোহিতবাবু। হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিয়ে তাঁর কাজ বাঙালি চিরকাল স্মরণে রাখবে। পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বাংলা এবং ইংরাজিতে অসংখ্য বই লিখেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কলকাতার পুকুরকথা’, ‘বাতাস হোক মধুময়’, পরিবেশের জাতপাত ইত্যাদি। মোহিতবাবুর মেধা ও মনন বিজেপির সম্পদ।

maxresdefault 3

৪। বিমলশঙ্কর নন্দ – বাংলা চ্যানেলের ডিবেটের পরিচিত মুখ বিমলশঙ্কর। পেশায় অধ্যাপক। সঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক। প্রায় প্রতিদিনই টিভির বিতর্ক অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে দেখা যায় তাঁকে। তৃণমূলের কট্টর সমালোচক হিসাবেই তিনি পরিচিত।

Top 9 Benefits of Social Media for Your Business

৫। এই তালিকার সঙ্গে মানাইসই না হলেও শেষে যাকে রাখতেই হবে সে হল সোশ্যাল মিডিয়া – হ্যাঁ, চমকাবেন না। এটাই সত্যি। আরব স্প্রিং থেকে শুরু করে সুশান্ত সিং রাজুপুত মৃত্যু মামলা হয়ে বাবা কি ধাবা – সোশ্যাল মিডিয়া তার কামাল দেখিয়েই চলেছে। এবং ভবিষ্যতেও দেখাবে। যে দরিদ্র, নিপীড়িত সমাজের হয়ে গর্জে ওঠার কাজ বুদ্ধিজীবীরা করেন, মানতেই হবে বর্তমানে সেটাই হচ্ছে এই মাধ্যমে। সমাজের জাগ্রত বিবেকের কাজ করছে সোশ্যাল মিডিয়া। বিজেপির আইটি সেলের সৌজন্যে তা গেরুয়া শিবিরের কাছে বুদ্ধিজীবীর স্পর্শ তো বটেই। আর মোদী ঝড়ের পেছনে যে সোশ্যাল মিডিয়ার অবদান ছিল সেটাও তো ভুলে গেলে চলবে না।

তথাকথিত প্রিন্ট এবং বৈদ্যুতিন চ্যানেল যেখানে কাজ শেষ করছে, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো কাজ শুরু করছে সেখান থেকে। লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৮ টা সিট পাওয়ার পেছনে যতটা হিন্দুত্ববাদের উত্থান ছিল ততটাই ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার ক্যারিশমা। লাগাতার প্রচার। ন্যারেটিভ তৈরি। অজানা জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের খবরকেও টেনে বের করে আনার দক্ষতা। এই করোনা কালে, যখন মাঠে ময়দানে প্রচার প্রায় বন্ধ হতে চলেছে তখন এই মাধ্যম যে ২১-এর ফাইনাল ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে সেটা নিশ্চিত। এই জায়গা থেকেই আগামী দিনে এরাই হয়ে উঠতে পারেন গেরুয়া শিবিরের তুরুপের তাস।