তিনি মূলত সঙ্ঘের লোক। প্রচারকের কাজ করেছেন। সেখান থেকে এসেছেন বিজেপিতে। গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়ে জীবনের প্রথম নির্বাচনেই হারিয়ে দেন খড়্গপুর কেন্দ্রের ‘চাচা’ জ্ঞান সিং সোহনকে। হ্যাঁ তিনি দিলীপ ঘোষ। এই জয় দিয়েই রাজনৈতিক জীবনের উত্থান শুরু হয় অধুনা বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতির।

দিলীপ ঘোষের আমলেই পশ্চিমবঙ্গে মাটি শক্ত করেছে পদ্মশিবির। লোকসভায় ১৮ টা সিট জিতেছে। শুধু তাই নয়, ২০২১-এ তৃণমূলকে হারিয়ে ক্ষমতা দখলের স্বপ্নও দেখছে গেরুয়া শিবির। এর কৃতিত্ব তো দিলীপ ঘোষেরই প্রাপ্য। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হয় না। দিলীপ ঘোষের কৃতিত্ব নিয়ে চলে যায় হিন্দুত্ববাদীরা। তার কারণ, দিলীপ ঘোষের বাগাড়াম্বর।

এটাই দিলীপ ঘোষের সবচেয়ে বড় নেগেটিভ পয়েন্ট। কোথায় কতটুকু বলতে হয়, সেটা দিলীপ ঘোষ জানেন না। এও বাহ্য। তিনি মুখ খুললেই নতুন বিতর্কের জন্ম হয়। এককথায় বলতে গেলে বঙ্গের রাজনীতিতে দিলীপ ঘোষ এবং বিতর্ক সমার্থক শব্দ। সে গরুর দুধে সোনা পাওয়া যায় থেকে সদ্য নোবেলজয়ী অভিজিৎকে ‘হাফ বাঙালি’ বলে দেওয়া – এখানে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দিলীপ ঘোষের বহুল আলোচিত ৫ টি বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে চর্চা করলাম আমরা।

১। গরুর দুধে সোনা আছে – বর্ধমান টাউন হলে ঘোষ ও গাভী কল্যাণ সমিতির এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এই মন্তব্যটি করেছিলেন দিলীপ ঘোষ। তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতীয় গরুর বৈশিষ্ট্য, তার দুধের মধ্যে সোনার ভাগ থাকে। তার জন্য দুধের রঙ একটু হলদেটে হয়। আমাদের দেশের গরুর যে কুঁজ থাকে, তা বিদেশী গরুর মধ্যে থাকে না। তাদের পিঠটা সমান, মোষের মত। গরুর কুঁজের মধ্যে একটা নাড়ি থাকে তাকে স্বর্ণনাড়ি বলে। সেখানে সূর্যের আলো পড়লে সোনা তৈরি হয়। সেই জন্য গরুর দুধ হলদে হয়, সোনালি হয়।’ যদিও প্রাণীবিজ্ঞানীরা নাকচ করে দেন দিলীপ ঘোষের তত্ত্ব। ভূ-ভারতে এমন কোনও গবেষণা হয়নি বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। বিজেপি বাংলাতেও গোবলয়ের রাজনীতি করতে চাইছে বলে সরব হয়েছে বিরোধীরা।

২। ‘সহজ পাঠ’ বিদ্যাসাগরের লেখা – লোকসভা ভোটের শেষ দফার আগে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে উত্তাল বঙ্গের রাজনীতি। যার আঁচ গিয়ে পড়েছে কেন্দ্রেও। অমিত শাহের রোড শো থেকেই বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে বলে সোচ্চার তৃণমূল। ঠিক সেই সময়েই শিলিগুড়িতে সাংবাদিক সম্মেলনে দিলীপ ঘোষ বলে বসলেন, ‘সহজ পাঠ লেখার জন্য বিখ্যাত বিদ্যাসাগর। আমরা তাঁর লেখা এই বই ছোট বেলায় পড়েছি।’ এখানেই না থেমে ঘোষবাবু বলেন, ‘কিন্তু বাম আমলে সহজ পাঠ তুলে দেওয়া হয়েছিল। যদি টিএমসিপির বিদ্যাসাগরের প্রতি সম্মান থাকত, তাহলে সহজ পাঠ চালু করত।’

৩। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অর্ধেক বাঙালি – অভিজিতের নোবেল প্রাপ্তিতে বাঙালি হিসাবে গর্ব করছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ। ঠিক সেই সময়ে একফোঁটা দুধে চোনার মতো অভিজিৎকে ‘অর্ধেক বাঙালি’ হিসাবে দেগে দেন দিলীপ ঘোষ। বিজেপির কলকাতা সদর দফতরে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘শুনতে পাচ্ছি তাঁর যে বিদেশিনী স্ত্রী আছেন, নোবেনজয়ীর তালিকায় তারও নাম আছে৷ এক পরিবারের দু’জন নোবেল পাওয়া – তিঁনি অর্ধেক বাঙালি তো বটেই৷ এর জন্য আমরা গর্বিত৷’ এই মন্তব্য নিয়ে সোশ্যাল সাইটে ঝড় উঠতে সময় লাগেনি। এতে আখেরে ক্ষতি হয়েছে বিজেপিরই। তাদের বাঙালি বিরোধী দল বলে দাগিয়ে দিয়েছে বিরোধীরা।

৪। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করলে কুকুরের মতো গুলি করে মারা উচিৎ – সিএএ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে উত্তাল দেশ। উত্তর পশ্চিম ভারতের অসম ও অন্যান্য রাজ্যে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। আঁচ লেগেছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাগুলিতেও। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বাস, ট্রেন। এরপরেই এক জনসভায় দিলীপ ঘোষ বলেন, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করলে কুকুরের মতো গুলি করে মারব। এখানে আসবে, খাবে, আর এখানকার সম্পত্তি নষ্ট করবে? জমিদারি পেয়েছ নাকি? গুলিও করব, লাঠি মারব, জেলে ঢুকিয়ে দেব।’

৫। বুদ্ধিজীবীরা বরং কুকুরের মাংস খান – ‘যেসব বুদ্ধিজীবীরা গোমাংস খেতে পছন্দ করেন, তাঁদের কুকুরের মাংস খাওয়া উচিত।’ গোমাংস খাওয়া নিয়ে এভাবেই বুদ্ধিজীবীদের নিশানা করেছিলেন দিলীপ ঘোষ। ফলে বিতর্ক বেড়েছিল। সঙ্গে বুদ্ধিজীবী, লেখক শিল্পীরা মুখ ঘুরিয়েছিলেন বিজেপির থেকে। দিলীপ বলেছিলেন, ‘অনেক শিক্ষিত লোক রয়েছেন, যাঁরা রাস্তার ধারে গো মাংস খান। কেন শুধু গরু খান? তাঁরা তো কুকুরের মাংসও খেতে পারেন। অন্যান্য পশুর মাংসও খেতে পারেন। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। কিন্তু নিজের বাড়িতে বসে খান। গরু আমাদের মা, গোহত্যাকারীদের সমাজবিরোধী হিসেবেই দেখি।’

এহেন মন্তব্যের জন্য প্রায়শই সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলড হন দিলীপ ঘোষ। সমালোচকরা বলেন, তিনি রাজনীতিক নন, বরং মিম মেটেরিয়াল। তাঁকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা চলতে পারে। সিরিয়াস আলোচনা নয়। ফলে রাজনৈতিক কারণের থেকে বেশি বিতর্কিত মন্তব্য করেই সংবাদ শিরোনামে থাকেন দিলীপ ঘোষ।