জেনে নিন শীতের পিঠে-পুলির গল্পকথা—আচ্ছা পিঠে-পুলি নাম শুনলে কি জিভে জল আসে? মনে হয় যদি একবার কাছে পেতাম তাহলে এক্ষুনি সাঁটাতাম? আরে মনে হবে নাই বা কেন, বাঙালি তো! বাঙালি আর পিঠে খেতে ভালবাসবে না এমনকি হয় নাকি! তা এই পিঠে নিয়েই নানা রকম তথ্য আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করে নিই চলুন।
পিঠে-পুলি কি?
পিঠে পুলি হল বাঙ্গালীর ঐতিয্য। পিঠে-পুলি প্রাথমিকভাবে ধানের আটা বা গমের ময়দা থেকে তৈরি করা হয়, যা আকারযুক্ত এবং বিকল্পভাবে মিষ্টি বা মজাদার রকমারি উপাদান দিয়ে ভরা হয়। পিঠে-পুলি একইরকম একটি প্রকরণ। আমরা পিঠেকে কেকের ভারতীয় ভার্সন বলতে পারি। কিন্তু না এটিকে পিঠে-ই বলবো।
পুরানো দিনে কিভাবে বানানো হত পিঠে-পুলি ?
বর্তমানকালে পিঠে পুলি বানানোর জন্য অনেক নতুন নতুন উপাদান, কাঠামো, ছাঁচের আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু পুরানো দিনের হাতে তৈরি পিঠেপুলির স্বাদই আলাদা। পুরানো দিনে মা- ঠাকুমারা শিলনোড়াতে চাল গুঁড়িয়ে, সেই চালগুঁড়ো গরম জল দিয়ে মেখে তার ভিতরে নারকেলের বা ক্ষীরের পুর দিয়ে পিঠের আকার দিয়ে রাখত। মা ঠাকুমার হাতে থাকত এক অদৃশ্য যাদু , সেই যাদুতে এই পিঠে পুলির স্বাদ তিনগুন হয়ে যেত।
এরপর কাঠের উনানে জল গরম করে তারমধ্যে সেই রেখে দেওয়া পিঠেপুলি কাপড়ের পুঁটুলি করে ছেড়ে দিত আবার সড়ার মধ্যে পিঠের মিশ্রন দিয়ে আগুনের ভাপে তৈরি হত পিঠে। এভাবেই তৈরি হতো সুস্বাদু পিঠে যা নলেন গুড়ে বা ঝোলা গুড়ের সঙ্গে খাওয়া হত। এভাবে পিঠে বানানো ছিল যথেষ্ট খাটনির।
বর্তমান দিনে কিভাবে বানানো হয় পিঠে-পুলি?
বর্তমান দিনে সবই যন্ত্রের খেলা। কোন জিনিসের জন্য যন্ত্র তৈরি হয়নি? যন্ত্রের মাধ্যমে চাল গোঁড়ানো থেকে শুরু করে মন্ড তৈরি করা কিংবা তারপরে পিঠে সিদ্ধ করা সমস্ত কিছুই হয় যন্ত্রের সাহায্যে।
কোথায় এবং কিভাবে সংঘটিত হয় কলকাতার পিঠে-পুলি উৎসব?
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তারমধ্যে মকর সংক্রান্তিও পরে। যা বাঙালির কাছে বা বলা যায় সমস্ত ভারতবাসীর কাছে পৌষ পার্বণ নামে পরিচিত। এটি একটি পবিত্র উৎসব। তবে শহুরে মানুষেরা বাঙালির নস্টালজিয়া পিঠে-পুলি উৎসব ভুলতে বসেছিল।
ঠিক সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে কলকাতার কসবায় পিঠে-পুলি উৎসব এর আয়োজন হয়। যেখানে পুরো মেলাটাই হয় পিঠে-পুলি উৎসব কে ঘিরে। বিভিন্ন রকমের পিঠের সম্ভার সাজিয়ে বিক্রেতারা বসেন এবং প্রচুর খাদ্য রসিক বাঙালি ক্রেতা সেই পিঠে দিয়ে রসস্বাদন করেন।
চলুন এবার দেখে নিন জনপ্রিয় কিছু পিঠে পুলির রেসিপি:–
১) দুধ পুলি:–
দুধ পুলি পিঠে বানাতে চালের গুঁড়োর মন্ড, নারকেল গুঁড়ো, এবং ঘন দুধ একসাথে মিশ্রিত করা হয়। অনেক সওয়াব পিঠের মধ্যে দুধপুলি খুবই জনপ্রিয় একটি পিঠে।
দুধ পুলি বানানোর উপকরণ:
পুলি তৈরির জন্য—
- চাল গুঁড়ো : 1 কাপ
- ফুটন্ত জল: 1 কাপ বা আরও বেশি
- ঘি: 2 টেবিল চামচ
- লবণ: একটি ছোট চিমটি
ঘন দুধের জন্য
- দুধ: 1.5 লি
- এলাচ সবুজ: 4-5 টুকরা
- গুড় (খেজুরের গুড় ব্যবহার করুন): কাপ
স্টাফিং
- নারকেল: 4 কাপ
- গুড় / গুর: 2 কাপ বা আরও বেশি
- জায়ফল গুঁড়ো: এক চিমটি
দুধ পুলি বানানোর পদ্ধতি:
পুলি / ডাম্পলিংয়ের জন্য—
- গরম জল আনুন এবং চালের গুঁড়োর মধ্যে একটু নুন দিয়ে আস্তে আস্তে জল ঢালতে শুরু করুন।
- কোনও লাঠির সাহায্যে এটি যত তাড়াতাড়ি মিশ্রিত করার চেষ্টা করুন
- এটি মোটামুটিভাবে মিশ্রিত হয়ে গেলে, অল্প এটি ঠান্ডা হতে দিন।
- ঘি দিয়ে আঙুলটি গ্রিজ করুন এবং গরম থাকা অবস্থায় ময়দা মেখে নিন।
- আটা গরম হওয়ায় এটি কিছুটা কঠিন, তবে এটি করার একমাত্র উপায়।
- ময়দা মাখার পরে, এটি নরম হবে, ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত এটি একটি স্যাঁতসেঁতে তোয়ালে দিয়ে রান্নাঘরে ভালভাবে রেখে দিন।
ঘন দুধ প্রস্তুত করুন:
- দুধটি দ্রুত ফুঁটতে দিন, আঁচ কমিয়ে নিন এবং কম পরিমাণে ফুঁটতে দিন যতক্ষণ না এটির পরিমাণ অর্ধেক কমে যায়।
- এটি আধা ঘন্টা সময় নিতে হবে।
- ঘন দুধে তৈরি করা পুলি দিন, যা আপনি কম আঁচে রেখেছেন।• ময়দা সমান আকারে ভাগ করুন এবং এগুলি থেকে ছোট ছোট বল তৈরি করুন।
- ময়দা সমতল করুন এবং আঙ্গুলের সাহায্যে, আকারের মতো বাটি দিন।
- পুরটি মাঝখানে রাখুন, এটি ক্রিসেন্ট চাঁদের আকারের মতো ভাঁজ করুন।
- আপনার আঙুল দিয়ে পিঠের কিনারাটি সিল করুন, হয় পাশগুলিকে ক্রিম্পিং করে দিন কাঁটাচামচ সাহায্যে।• এটি 5-7 মিনিটের জন্য সিদ্ধ হতে দিন।
- রান্না হয়ে গেলে পুলি দুধের উপরে ভেসে উঠবে।
- এটি সরান এবং অন্য একটি দুধে রাখুন।
- পাত্রের আকারের উপর নির্ভর করে আপনি এটি ব্যাচগুলিতে তৈরি করতে পারেন। তবে উপচে পড়া ভিড় করবেন না তা ভেঙে যাবে।
- একবারে সমস্ত পুলি রান্না হয়ে গেলে, স্লটেড চামচ দিয়ে এগুলি সরান এবং এটি পরিবেশন ডিশে রাখুন।
- পছন্দসই ধারাবাহিকতায় দুধ আরও কমিয়ে আনুন। শিখা বন্ধ করুন। গুড় যোগ করুন এবং গুড় পুরোপুরি গলে যাওয়া পর্যন্ত ভাল করে নাড়ুন।
- দুধ পুলির উপরে ঘন দুধ ঢেলে দিন।
- উষ্ণ বা কক্ষ তাপমাত্রায় পরিবেশন
২) ভাপা পিঠে:–
বাঙ্গালিদের অন্যতম জনপ্রিয় পিঠে হলো ভাপা পিঠে। এই পিঠে অতিসাধারণ কিন্তু খেতে খুবই সুস্বাদু।
ভাপা পিঠে বানানোর উপকরণ:
- 2 কাপ চালের ময়দা
- 1½ কাপ তাজা নারকেল গুঁড়ো
- 1½ কাপ জল, বাষ্পের জন্য অতিরিক্ত
- 1 চা চামচ লবণ
- 1 কাপ খেজুর গুড়, মোটা করে ছোট ছোট টুকরো টুকরো করা
- ½ কাপ দুধ, যদি স্বাদহীন নারকেল ব্যবহার করা হয় (ঐচ্ছিক)
আইটেম প্রয়োজন:
- স্ট্যান্ডার্ড পেপার ন্যাপকিনের আকার সম্পর্কে সাদা মসলিন কাপড়ের 2 টুকরা
- পিঠা আকৃতির একটি গভীর, ছোট, গোল পাত্রে
- পাত্র বা সসপ্যান এবং অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল
ভাপা পিঠে বানানোর পদ্ধতি:
ভাপা তৈরির প্যান না থাকলে পিঠা তৈরির প্যান প্রস্তুতের পদক্ষেপ:
- জল দিয়ে একটি সসপ্যানের অর্ধেকটি পূরণ করুন এবং এটিকে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের ডাবল স্তর দিয়ে এমনভাবে ঢেকে রাখুন যাতে বাষ্প বেরোতে না পারে।
- কাঁটাচামচ ব্যবহার করে ঢাকা ফয়েলটির মাঝখানে কয়েকটি গর্ত এমনভাবে তৈরি করুন যাতে বাটি রাখলে বাষ্পগুলি বেরোতে না পারে আপনি ভাপা পিঠা তৈরিতে ব্যবহার করবেন।
পিঠা তৈরির পদক্ষেপ:
- চালের ময়দা। লবণ যোগ করুন. ½ কাপ নারকেল যোগ করুন।
- স্যাঁতস্যাঁতে ময়দার মিশ্রণটিতে এক সময় অল্প পরিমাণে জল ছিটিয়ে দিন। ময়দার মিশ্রণটি ময়দার মতো বা পিঠার মতো না হলেও কেবল ভিজা হওয়া উচিত। কমপক্ষে 30 মিনিটের জন্য আলাদা করে রাখুন।
- স্বাদহীন নারকেল ব্যবহার করা হলে দুধ যোগ করুন এবং নারকেলটিতে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব আনুন।
- আলাদা বাটিতে পানি নিয়ে মসলিন কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে রাখুন। একপাশে সেট করুন।
- এবার হাতের মাধ্যমে স্যাঁতস্যাঁতে ময়দার মধ্যে একটু নুন দিয়ে গরম জলের সাহায্যে সেটি ভালোভাবে মাখুন।
- এরপর হাতের সাহায্যে মন্ডটিকে গোল করে তার মধ্যে নারকেল গুঁড়ো ভরে দিন।
- এরপর হাতের সাহায্যে সুন্দর পিঠের আকৃতি দিন।
- এবার সসপ্যানে পিঠে তৈরীর জন্য কিছুটা জল গরম করতে দিয়ে তার মধ্যে পিঠে গুলি দিয়ে দিন।
- এরপর 5-7 মিনিট সেটি রান্না হতে দিন।
- এরপর উনুন থেকে ভাপা পিঠে গুলি নামিয়ে নিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন খেজুরের গুড়ের সাথে।
৩) গোকুল পিঠে:–
বাঙালিদের মকর সংক্রান্তির উৎসবে তৈরি করা এক অন্যতম পিঠে হলো গোকুল পিঠে। এই পিঠে খেতে হয় খুবই সুস্বাদু এবং মিষ্টিও।
গোকুল পিঠে বানানোর উপকরণ:
- 200 গ্রাম নারকেল, গ্রেটেড
- 450 গ্রাম খোয়া
- 2/2 কাপ চিনি / খেজুরের গুড়
- দেড় গ্রাম ময়দা
- 5-6 কাপ জল
- 40 গ্রাম ঘি
- 1/8 চামচ সোডিয়াম বাইকার্বোনেট
গোকুল পিঠে বানানোর পদ্ধতি:–
- 4 কাপ জল দিয়ে 2 কাপ চিনি গরম করে চিনির সিরাপ তৈরি করুন।
- এটি ঠান্ডা হতে দিন। নারকেল, খোয়া এবং ২ টেবিল চামচ চিনি একসাথে মাঝারি আঁচে ভাজুন। একটানা নাড়ুন।
- পিঠে তৈরির জন্য, মিশ্রণটি রোল করুন এবং তালুর মাঝে সমতল করুন।
- আটা, বাকি জল, সোডিয়াম বাই কার্বনেট এবং ঘি মিশিয়ে ব্যাটার তৈরি করুন।
- প্রস্তুত ব্যাটারে গরম ঘি এবং নারকেল-দুধ দিয়ে রোল করে রাখা পিঠে গুলি দিয়ে নাড়তে থাকুন।
- সোনালি বাদামী হওয়া পর্যন্ত ভালোভাবে ভাজুন এবং চিনির সিরাপে ডুবিয়ে নিন।
তাহলে আপনি জেনে গেলেন তিন-তিনটি পিঠে তৈরীর রেসিপি। এছাড়াও অন্য কোন পিঠে তৈরীর রেসিপি আপনার জানা আছে নাকি? যদি জানা থাকে তাহলে আমাদের সাথে শেয়ার করুন নিচের কমেন্ট বক্সে।