ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে ভিক্ষাবৃত্তি রোজকার জলপানের মতোই স্বাভাবিক, হয়তো অনিবার্যও বটে। আমাদের প্রতিদিনের ব্যস্ত যাপনে পথচলতি মানুষের ভিড়ের ফাঁকে হামেশাই চোখে পড়ে দু’একটা বাড়িয়ে দেওয়া হাত। পাশে থাকার আশ্বাস নয়, সে হাতে লেগে থাকে অসহায়তার গ্লানি। বাড়িয়ে দেওয়া হাত পেতে ব্যস্ত শহরের কাছে ভিক্ষা চায় একদল ভিখারি।

22 07 51 images
the news international

কিন্তু, পথচলতি সেই অসহায় মুখ গুলোর মাঝে কখনো কারোর মাথায় পাগড়ি দেখেছেন কি? খুব চেষ্টা করেও হয়তো মনে করতে পারবেন না। কারণ, শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষেরা সচরাচর ভিক্ষা করেন না। নিতান্ত বেকায়দায় পড়লে হয়তো রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ছোটোখাটো জিনিস বিক্রি করতেও দেখা যেতে পারে শিখদের, কিন্তু ভিক্ষা? একেবারে নৈব নৈব চঃ। কেন ভিক্ষা করেন না শিখরা? কেন শত অসহায়তা সত্ত্বেও কখনো কোনো সর্দারজি রাস্তার ধারে হাত পেতে বসেন না? শুনলে অবাক হবেন আপনিও। আর শুধু অবাকই নয়, সেই সঙ্গে ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৭২ শতাংশ এই গোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার আভিজাত্যের কাছে হয়তো একবার হলেও নত হবে আপনার মাথা।

22 12 01 images
Scroll.in

পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে বর্তমানে ভিক্ষুক বা ভিখারির সংখ্যাটা সাড়ে ৪ লাখের কাছাকাছি। অর্থাৎ ৪ লাখের উপর ভারতবাসী কোনো কাজ না করে স্রেফ অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকেন। হাত পেতে ভিক্ষা নিয়েই চালান পেট, কাটিয়ে দেন দীর্ঘ জীবন। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভিক্ষাবৃত্তি হয়ে পড়ছে বংশানুক্রমিকও। ভারতবর্ষের মতো বহুমাত্রিক দেশ, যেখানে ৭০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থান করেন অথচ বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তিদের তালিকায় নাম লেখান মুকেশ আম্বানির মতো শিল্পপতি, সেখানে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য সমাজব্যবস্থা কতটা দায়ী সে প্রশ্ন তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি সমাজের পক্ষে নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর, তা যথার্থই বুঝেছেন শিখরা। তাই পারতপক্ষে ভিক্ষার থালা হাতে তুলে নেন না তাঁরা। জীবনযুদ্ধের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েও দক্ষ হাতে চালিয়ে যান শানিত কৃপাণ।

22 12 25 images
scroll.in

বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম লেখক হুমায়ুন আহমেদ তাঁর ‘হিমু’ উপন্যাস সমগ্রে একবার দেখিয়েছিলেন, শুধুমাত্র হাত পেতে টাকা নেওয়া ভিখারিদের মাসিক রোজগার সাধারণ ছোটোখাটো ব্যবসায়ী বা চাকুরিজীবীর চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর সে কথা যে খুব একটা মিথ্যে নয়, তা বলাই বাহুল্য। ভারতে অস্তিত্বশীল বিভিন্ন ধর্মেই ভিখারিকে ভিক্ষা দেওয়ার মধ্যে একপ্রকার আত্মগর্ব অনুভব করা হয়। কখনো কখনো আবার পুণ্যার্জনের লোভে এত টাকা দান করে ফেলেন কেউ কেউ, যে সহৃদয়তার সেই আতিশয্যে অন্তত মাস দুয়েক আর কোথাও হাত পাততেই হয় না ভিখারিকে। কিন্তু আদতে আধুনিক প্রগতিশীল সমাজের মেরুদন্ডটাই ভেঙে দেয় এই ব্যবস্থা।

22 07 10 images
india tv news

আচ্ছা ভাবুন তো একবার, পথচলতি মানুষের ভিড়ে স্রেফ হাত পেতে যদি আপনি দিনে শ’খানেক টাকা রোজগার করতে পারেন (তার বেশি ছাড়া কয় নয়) তাহলেও আপনার বাৎসরিক আয় গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪০ হাজার টাকার কাছাকাছি। দুর্মূল্যের বাজারে কোনো কাজ না করেই এই রোজগারের সুযোগ পেলে আপনি ছেড়ে দেবেন? আর যদি তা না করেন, তবে ভারত হয়তো ক্রিকেটের কিছু টুর্নামেন্ট জিততে পারবে, কিন্তু জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসনটা আর তার নেওয়া হবে না।

শিখ
dna india

ঠিক এই কারণেই শিখরা কখনো ভিক্ষা করেন না। যদি নিতান্ত গত্যন্তর না পেয়ে কোনো শিখ ভিক্ষার থালা হাতে তুলেও নেন, আর তাঁর ধর্মের অন্য কেউ তা দেখতে পান, তবে ভিক্ষা দেওয়ার বদলে ধর্মের বদনাম করার ‘অপরাধে’ তিনি প্রথমে তাঁকে ভর্ৎসনা করবেন। কিন্তু তারপর নিশ্চিতভাবেই ওই ভিখারির জন্য কিছু না কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। একদিনের সাময়িক ভিক্ষা, নাকি দীর্ঘস্থায়ী সাহায্য? ভেবে দেখুন তো, কোনটা বেশি দরকার?

22 09 57 images

বস্তুত, শিখদের এই আচরণের পিছনে রয়েছে একপ্রকার ধর্মীয় শিক্ষা। তবে সামাজিক চাপের বিষয়টাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। শোনা যায়, ১৯৮৪ সালের দেশ জোড়া শিখবিরোধী দাঙ্গায় ব্যাপক অস্তিত্ব সংকটে পড়েছিলেন ভারতীয় শিখরা।এ দেশের আনাচেকানাচে হাতেগোনা যে কজন সর্দারজি ভিখারি ছিলেন, ৮৪-র পর থেকেই তাঁরা ভিক্ষাপাত্র ত্যাগ করেছেন চিরতরে।

22 08 02 images
youngistan.in

ভিখারিদের টাকা দেন না শিখরা। তবে তাই বলে তাঁদের কিপটে বা হৃদয়হীন ভাবার কারণ নেই। শুনলে অবাক হবেন, শিখরাই এদেশে দানের নামে বিপুল পরিমাণ খাবার বিলিয়ে দেন গরীবদের মাঝে। অভুক্তের মুখে খাবার তুলে দেওয়াই শিখ সমাজের গর্ব। ভিখারিশূন্য এক সাম্যের ভারত গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপ তো নিয়েছে শিখসমাজ, চলুন না একবার আমরা সকলেই সে চেষ্টা করে দেখি? চলুন না, এদেশের মাটি থেকে মুছে দিই ওই ভিক্ষার থালাটাকে? সর্দারজিরা একা হয়তো তা পারবেন না, কিন্তু “শিখ, পারসিক,হিন্দু খ্রিস্টান, বৌদ্ধ,জৈন আর মুসলমান” নিয়েই তো তৈরি আমার আপনার ভারত! যেদিন দেশের বাকি সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই বার্তা ছড়িয়ে যাবে, হয়তো সেদিনই প্রকৃতরূপে মাথা তুলতে পারবে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘আত্মনির্ভর ভারত’। রইল সেই দিনটার অপেক্ষা।