বাঙালির দুর্গাপুজোর পঞ্চমীর দিন হঠাৎ করে দীর্ঘ তিন বছর পর জনসমক্ষে উদয় হন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বিমল গুরুং। তার এই আচমকা দর্শন শুধু পাহাড়বাসীদেরই নয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটা রাজনীতিসচেতন মানুষকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। কারণ গুরুংয়ের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগ সহ একাধিক খুন-হাঙ্গামার মামলা আছে। সরকারি সূত্রে জানা যায় তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১০০ বেশি। গত তিন বছর ধরে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন।পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়েছিল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আশ্রয় আছেন বিমল গুরুং রোশন গিরি। তাই তাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
গত তিন বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও সাধারণ মানুষ ভালোই বুঝতে পারছিল রাজনৈতিক নেতাদের হাত মাথার ওপর থাকায় শত অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছে। এই সময়ে গুরুং বারবার চেষ্টা চালিয়েছে দার্জিলিং পাহাড় নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে কোনো একটা সদর্থক পদক্ষেপ আদায় করবার। তার চেষ্টা ছিল পৃথক রাজ্য যদি নাও হয় সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে থেকেই সম্পূর্ণ স্বশাসিত অঞ্চলের দাবি কেন্দ্রের থেকে আদায় করে নেওয়া। তা যদি সম্ভব হত তবে এই গোর্খা নেতা জয়ীর বরমাল্য পড়ে পাহাড়ে রাজার মতো প্রত্যাবর্তন করতে পারতেন। যদিও তার সে দাবি পূরণ হয়নি। কারণ পূরণ হওয়া সম্ভব ছিল না। এত বড় সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের সঙ্গে পরামর্শ না করে নিজের ইচ্ছামতো নিয়ে নেবে তা ভাবাটা মুর্খামির সমান। সেইসঙ্গে পাহাড়ের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য সমতলের ভোট হারানোর এতো বড় ঝুঁকি বিজেপি নেবে না, যেখানে আগামী বিধানসভায় এরাজ্যের ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে তারা।
পাহাড় নিয়ে আম বাঙালির অদ্ভুত একটা আবেগ কাজ করে। তারা পাহাড়ের স্থানীয় জনগণের দুঃখ-দুর্দশা এবং দাবি দাওয়ার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করলেও পৃথক রাজ্যের দাবি মেনে নিতে কোনমতেই প্রস্তুত নয়। দার্জিলিং তাদের কাছে অহংকার। সেই অহংকার আলাদা রাজ্য হয়ে যাবে তা আম বাঙালির ঠিক হজম হবে না। তারা বড়জোর ষষ্ঠ তপশীলের অধীনে পাহাড়ের বেশ কিছুটা স্বায়ত্তশাসন মেনে নিতে রাজি আছে। স্বাভাবিকভাবেই এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি তাদের পাহাড় সংক্রান্ত নীতি প্রস্তুত করার সময় এই বিষয়টা মাথায় রাখে।
পাহাড় নিয়ে বিজেপি নানা সময়ে গুরুংদের নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পৃথক রাজ্যের স্বপ্নে বিভোর এই গোর্খা নেতা বিজেপির সেই সমস্ত প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে টানা তিনটি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীদের সমর্থন করে। স্বাভাবিকভাবেই গুরুংয়ের সমর্থন যে প্রার্থীদের দিকে থাকবে তারাই বিজয়ী হবে, এটাই ছিল পাহাড়ের অলিখিত নিয়ম। কিন্তু এই দীর্ঘ ১২ বছরে তাদের কোনো দাবি দাবি পূরণ না হওয়ার পর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার এই নেতা বোঝেন তাকে পাহাড়ে ফিরতে হলে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যদিও তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অতীতে যথেষ্ট তিক্ত ছিল।
অন্যদিকে তিন বছর আগে গুরুং পাহাড় ছাড়া হলে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দলের প্রধান মুখপাত্র বিনয় তামাং পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে গুরুং এবং রোশন গিরীর নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে। নিজের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীকেই আসল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা বলে দাবি করে বিনয় তামাং। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার এই গোষ্ঠীটি প্রথম থেকেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেছে। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের সময় তারা দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করে। অন্যদিকে বিমল গুরুং নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী বিজেপিকে সমর্থন করে। প্রকাশ্যে না এসেও বিভিন্ন অডিও ক্লিপের মাধ্যমে বিজেপি প্রার্থীর সমর্থনে প্রচার চালান তিনি। নির্বাচনের ফল প্রকাশ পেলে দেখা যায় ব্যাপক ভোটে বিজেপি প্রার্থী জিতে গিয়েছে। প্রমাণ হয়ে যায় বিনয় তামাং যতই রাজ্য সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলুক না কেন, পাহাড়ের জনগণের মনে বিমল গুরুংয়ের প্রতি সমর্থন আছে। এবার গুরুং অন্তরাল ছেড়ে সর্বসমক্ষে ফিরে আসায় এই রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে জল্পনা তীব্র হয়ে উঠেছে তার ও বিনয় তামাংয়ের মধ্যে কে শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের রাজনীতির নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠবে।
• বিমল গুরুংয়ের বাজি মারার সম্ভাবনা বেশি কেন ?
বিমল গুরুংয়ের সময় পাহাড়ে ধর্মঘট অশান্তি ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার। যা পাহাড়বাসীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। তবুও তার প্রতি পাহাড়বাসীর একটা আলাদা আবেগ কাজ করে। আসলে তার ওই জঙ্গী ভাবমূর্তিকেই বোধহয় বড় আপন মনে করে পাহাড়ের বাসিন্দারা। পাহাড়ের মানুষ জনের সঙ্গে কথা বললে দেখা যাবে তারা আর অশান্তি না চাইলেও মনে করে গুরুংয়ের চেষ্টার মধ্যে একটা সততা আছে। যদিও গুরুং যখন পার্বত্য উন্নয়ন পর্ষদের শীর্ষে ছিলেন তখনো খুব একটা উন্নয়নমূলক কোনো কাজ পাহাড়ে হয়নি। তবে তিনি যেহেতু নিজের হাতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা গড়ে তুলেছিলেন, তাই তার নেতৃত্বাধীন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকেই আসল বলে মনে করে বেশিরভাগ পাহাড়বাসী। সেইসঙ্গে ডুয়ার্স অঞ্চলের ১৫ টা বিধানসভা কেন্দ্রে যথেষ্ট প্রভাব আছে বিমল গুরুং অনুগামীদের। এই পরিস্থিতিতে অন্তরাল ছেড়ে তারা আবার প্রকাশ্যে আসায় তাদের প্রতি পাহাড়বাসীদের আস্থা আরো বৃদ্ধি পাবে বলেই অনুমান করা যায়। সে ক্ষেত্রে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে পাহাড় এবং ডুয়ার্স অঞ্চলের বেশিরভাগ তৃণমূল প্রার্থী যদি গুরুংয়ের পছন্দমত নির্ধারিত করা হয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিমল গুরুং বেঁকে বসায় পাহাড়ের ভোট অত্যন্ত কঠিন হয়ে গিয়েছে বিজেপির কাছে। যদিও জিএনএলএফের সমর্থন তাদের সঙ্গে আছে।
• কি হতে পারে বিনয় তামাংয়ের অবস্থান?
গুরুং ফিরে আসায় বিনয় তামাংরা ইতিমধ্যেই অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে শুরু করেছে। যদিও তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফ থেকে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে রাজনীতির কূটকৌশলে এই মুহূর্তে যথেষ্ট বেকায়দায় তামাং গোষ্ঠী। সেই সঙ্গে পাহাড়ে বাসিন্দাদের একাংশ এরমধ্যে তাদের প্রতি যথেষ্ট ক্ষোভ আছে। তাদের অভিযোগ পাহাড় জুড়ে “কমিশন রাজ” প্রতিষ্ঠা করেছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার এই গোষ্ঠী।
তৃণমূল নেতৃত্ব ক্রমশ বুঝতে শুরু করেছে ভোটে সাফল্য এনে দেওয়ার ক্ষমতা তামাং গোষ্ঠীর নেই। তার জন্য গুরুং হতে পারে শেষ ভরসা। এই পরিস্থিতিতে বিনয় তামাংয়ের সামনে দুটো পথ খোলা আছে-
১) তৃণমূলের সঙ্গেই থেকে যাওয়া। গুরুং তৃণমূলের প্রতি সমর্থন জানানোয় বিনয় তামাংদের গুরুত্ব ইতিমধ্যেই অনেকটা কমে গিয়েছে রাজ্যের শাসক দলের কাছে। তা সত্ত্বেও তামাংরা তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে থেকে যেতে পারে। তাহলে পার্বত্য উন্নয়ন পর্ষদের পদটা অন্তত বিনয় তামাং-অনিত থাপাদের হাতে থেকে যেতে পারে সান্তনা পুরস্কার হিসাবে।
২) বিজেপি শিবিরে শামিল হতে পারে বিনয় তামাংরা। গুরুংয়ের শূন্যস্থান পূরণ করতে বিনয় তামাংদের স্বাভাবিকভাবেই কাছে টেনে নেবে বিজেপি। যদিও তাতে কাজের কাজ কতটা হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এছাড়া জিএনএলএফের সঙ্গে বিজেপির সুসম্পর্ক থাকায় তামাংরা ততটা গুরুত্ব নাও পেতে পারেন বিজেপি নেতৃত্বের কাছে।
তবে শেষ মুহূর্তে গুরুংয়ের বাড়া ভাতে ছাই ঢালতে নতুন কৌশল নিতে পারে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। পাহাড়ের বেশিরভাগ মানুষ বিভিন্ন চা বাগানে কাজ করে। এই চা বাগানগুলির শ্রমিক-কর্মচারীরা একসময় অনেক সুযোগ সুবিধা পেত বাগান মালিকদের কাছ থেকে। বর্তমানে সেই সব সুযোগ-সুবিধা তো নেই, বরং তাদের মজুরিও দীর্ঘদিন ধরে প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার যদি চা বাগানগুলির শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম মজুরি আইন তৈরি করে, সে ক্ষেত্রে লাক্ষাধিক চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সমর্থন বিজেপির দিকে ঢলে পড়তে পারে। সেই সঙ্গে সুভাষ ঘিসিংয়ের জিএনএলএফ বেশ অনেকটাই শক্তি বাড়িয়ে বিজেপির অন্যতম শরিকে পরিণত হয়েছে।
নানান পরিস্থিতি বিচার বিবেচনা করে বলাই যায় পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন করে টেক্কা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বিমল গুরুংয়ের সবথেকে বেশি। তার এই সমর্থন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে তৃণমূলের কাছে অন্যতম বড় হাতিয়ার।