পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী মানচিত্রে বরাবরই একটি ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। লোকসভা ভোটে নির্দল প্রার্থীদের বিশেষ জায়গা না থাকলেও বিধানসভা নির্বাচনে আদিবাসী প্রধান অঞ্চলগুলিতে বিভিন্ন ছোট ছোট আঞ্চলিক দল ও নির্দল প্রার্থীরা অনেক সময় ভোটের প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে বিক্ষুব্ধ নির্দল প্রার্থীদের ভোট কাটাকাটির ফলে ভোটের ফলাফল অনেক সময়ই বদলে গিয়েছে এ ঘটনা অতীতে প্রচুর দেখা গিয়েছে। যেমন ২০১১ সালের ঐতিহাসিক বিধানসভা ভোটে সর্বত্র তৃণমূল জিতলেও ভাঙরে আরাবুল ইসলাম নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোট কাটায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এই কেন্দ্রটিতে জিতে গিয়েছিল সিপিআই(এম)। আবার জঙ্গলমহলে ঝাড়খন্ড পার্টি বা আদিবাসী গোষ্ঠীর নির্দল প্রার্থীদের ভোট কাটাকাটি খেলায় অনেক সময়ই ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সেই ধারা সম্পূর্ণ বদলে গেল।

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে অন্যতম প্রধান নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক মইনুদ্দিন শামস। বীরভূম জেলার নলহাটি কেন্দ্র থেকে ২০১৬ এর বিধানসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে তিনি জয়ী হন। এবার দল তাকে প্রার্থী না করলে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এবারের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েও পরাজিত হয়েছেন পুরুলিয়ার জয়পুর কেন্দ্রের এক প্রার্থী। রাজপরিবারের এই সদস্য আসলে তৃণমূল সমর্থিত নির্দল ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাকে চিরাচরিত দলহীন গোষ্ঠীর মধ্যে ধরা যাবে না।

এবারের নির্বাচনে অনেকেই নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট দেখে বুঝেছেন কালিম্পং কেন্দ্রে এক নির্দল প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রতীক নির্বাচন কমিশন ফ্রিজ করে দেওয়ায় তারা এবারের নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তারমধ্যে কালিম্পং জেলার একমাত্র আসনে বিনয় তামাং পন্থী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তিনিও তৃণমূল সমর্থিত ছিলেন। অর্থাৎ এই প্রার্থীকেও চিরাচরিতভাবে নির্দল তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।

সেক্ষেত্রে মইনুদ্দিন শামস নির্দল হিসাবে লড়াই করলেও তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড যথেষ্ট ঈর্ষণীয়। কিন্তু সেই তিনি ভোটের ময়দানে মাত্র ১,৮৩২ টি ভোট পেয়ে জামানত বাজেয়াপ্ত হন। আগের বার‌ যে কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন সেখানে তার এই ফলাফল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

সে দিক থেকে দেখতে গেলে সম্পূর্ণ নতুন মুখ হিসেবে উঠে আসা এবং কোনওরকম রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্বেও এই মেরুকরণের নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে অন্যতম নজর কেড়েছেন বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের ডিশ অ্যান্টেনা চিহ্ন নিয়ে লড়াই করা নির্দল প্রার্থী দীনেশ দাস। এই নির্দল প্রার্থীর কোনরকম রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্ত্বেও ১,৪৮০ ভোট পেয়ে রাজ্যবাসীর নজর কেড়েছেন। প্রকৃত নির্দল হিসাবে রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া যারা লড়াই করেছেন এবারের নির্বাচনে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন দীনেশ দাস।

বনগাঁ উত্তরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে দীনেশ দাসের ভোট প্রচারের কথাগুলি সেখানকার স্থানীয় মানুষের মধ্যে বেশ ভালো মতো সাড়া ফেলেছে। তিনি যে স্বনির্ভরতার কথা এবং নিজের পথ নিজেই রচনা করার স্বপ্ন ফেরি করেছেন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তা নিয়ে অনেকেই আলোচনা করছেন। কিন্তু এই নির্বাচন যেহেতু ছিল চূড়ান্তভাবে বিজেপির পক্ষ এবং বিপক্ষ নির্ধারণ করার ভোট, তাই সেখানকার একটা বড়ো অংশের মানুষের মনে দীনেশ দাস’কে সমর্থন করার ইচ্ছা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেটা পেরে ওঠেননি। তার মধ্যেও এই নির্দল প্রার্থী যে ফলাফল করেছেন তা আগামী দিনে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগাবে বলেই মনে হয়। অন্তত বনগাঁর মানুষ তার অপেক্ষায় আছে।