ভারতের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই মুহূর্তে দেশের সক্রিয় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৯ লাখের গণ্ডি পেরিয়েছে। একই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও। এই রাজ্যে বর্তমানে ভোট প্রক্রিয়া চলার ফলে সরকারি স্তর থেকেই করোনা বিধি মেনে চলার পক্ষে যেন এক গা-ছাড়া মনোভাব দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে বড়ো কথা দেশের বাকি সমস্ত অংশে সরকারি তৎপরতা এবং সাধারণ মানুষের ভয়ের কারণে জমায়েত কম হলেও বাংলায় এখন হাজার হাজার মানুষের জমায়েত নিত্যদিনের ঘটনা। কেবলমাত্র কুম্ভ মেলা ব্যতীত বর্তমান সময়ে এত বড়ো এবং ঘন ঘন জমায়েত পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আর কোথাও হয়নি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরিষ্কার জানিয়েছেন অবিলম্বে সচেতন না হলে ঘোর বিপদ দোরগোড়ায় অপেক্ষা করছে।

এক সময় মনে হচ্ছিল মানুষের প্রাণ যায় যাক তবু রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা দখলের যুদ্ধে বিন্দুমাত্র শিথিলতা দেবেন না। মজার বিষয় হচ্ছে যুদ্ধ কথাটা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু করোনার সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নির্বাচনী যুদ্ধ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিচ্ছে। কারন যত বেশি কর্মী-সমর্থক নেতাদের কথা শুনতে ভিড় করবেন ততই নিজেদের সার্থক মনে করেন রাজনৈতিক নেতারা। স্বাভাবিকভাবেই করোনা বিধির সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে ভিড় বেড়েই চলেছে বাংলার মাঠে ময়দানে। কিন্তু কাহানি মে টুইস্টের মত রবিবার সকালে হঠাৎ কংগ্রেসের প্রধান মুখ রাহুল গান্ধী ঘোষণা করলেন এই করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে তিনি ভোট প্রচারে বাংলায় আসছেন না। কংগ্রেসের এই প্রাক্তন সভাপতি বিরোধী দলের নেতাদের‌ও এই পরিস্থিতিতে ভোট প্রচার করা কতটা সমীচীন হচ্ছে সেই বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ জানান।

রাহুল গান্ধীর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন তিনি তার প্রতিটি নির্বাচনী সভাকে সংক্ষিপ্ত করে দেবেন। তার হাতে গরম প্রয়োগ সোমবার দেখেছে রাজ্যবাসী। বামেরা অবশ্য অনেক আগে ১৩ এপ্রিল ঘোষণা করে দিয়েছিল তারা আর কোন‌ও বড়ো রোড শো বা সভা করবে না। কারণ ওই একই, করোনা প্রতিরোধ করতে হলে ভিড় করা চলবে না। কিন্তু এই বাংলার ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের আর এক প্রবল পক্ষ বিজেপি এক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তাদের পরিষ্কার বক্তব্য ভোটের প্রচারের জন্য করোনা ছড়াচ্ছে না। আর‌ও অনেক কিছু বলছেন বিজেপি নেতারা। কিন্তু তার সবকিছু মিলিয়ে মূল নির্যাস যেটা বেরিয়ে আসছে তা হল ভোটের লড়াইয়ে তারা বিন্দুমাত্র শিথিলতা দেখাতে রাজি নয়। তাই বিরোধীরা বড়ো বড়ো জমায়েত না করলেও তারা দলের হেভিওয়েটদের দিয়ে বড়ো বড়ো সভা সমাবেশ করে ক্ষমতা প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

এই পরিস্থিতিতে রাহুল গান্ধীর সিদ্ধান্ত শুধু বাংলা নয় ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য এই সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে অবশ্য বলেছেন, “রাহুল গান্ধী জনসভা না করে আসলে নাটক করছেন।” তার পরিষ্কার বক্তব্য পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ভালো ফলাফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই দেখেই রাহুল করোনাকে অজুহাত করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। আবার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তঁর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের বক্তব্য রাহুল এই পদক্ষেপ নিয়ে আসলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তার দেখানো পথ ধরে বাকি রাজনৈতিক নেতাদের এগিয়ে আসা উচিত।

রাহুল গান্ধীর পদক্ষেপ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় রাজনীতিতে তার এই সিদ্ধান্ত কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে তা আমরা একটু অনুসন্ধান করে দেখি।


[ ] ব্যতিক্রমী ভাবমূর্তি গড়ে তুললেন রাহুল-

রাহুল গান্ধী ভারতীয় রাজনীতিতে কত গুরুত্বপূর্ণ নেতা বা তার প্রভাব কতটা সেটা সম্পূর্ণ আলাদা বিতর্ক। কিন্তু তিনি যে বরাবর প্রগতিশীল ভাবমূর্তি নিয়ে এগিয়ে চলেছেন তা অনিশীকার্য। করোনার জন্য পশ্চিমবঙ্গে ভোট প্রচারে আর না আসার এই সিদ্ধান্ত তার সেই ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ নরেন্দ্র মোদী এই সময় হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে জনসভা করে গিয়েছেন। অথচ রাজনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও রাহুল মানুষের স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে জনসভা করলেন না। এই ঘটনা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কাছে তার ভাবমূর্তিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।


[ ] দলের থেকে মানুষ আগে নিতীর প্রকৃত রূপায়ণ ঘটালেন-

নরেন্দ্র মোদী বারবার বলেন তার কাছে দলের থেকে দেশ আগে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল প্রয়োজনের সময় এই নীতির সফল প্রয়োগ করলেন রাহুল। তিনি বুঝিয়ে দিলেন দলীয় লাভ ক্ষতির অঙ্ক অনেক পিছনের বিষয়, আগে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য। তাদের জীবন। স্বাভাবিকভাবেই কোথাও একটা গিয়ে নরেন্দ্র মোদির মুখ পুড়ল। ক্ষুন্ন হল তার সেই বিখ্যাত ভাবমূর্তি।


[ ] জাতীয় স্তরে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা-

নরেন্দ্র মোদির বিপক্ষে প্রধান মুখ হিসেবে রাহুল গান্ধী একসময় উঠে আসছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তার কিছু খামখেয়ালি পদক্ষেপ সেই জায়গাটা অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছিল। তবে তার এই দৃঢ় সিদ্ধান্ত বুঝিয়ে দিল তিনি প্রয়োজনে সঠিক অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রে পিছপা হন না। স্বাভাবিকভাবেই মোদির বিরুদ্ধে প্রধান মুখ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে আবারও যেন ফিরে এলেন রাহুল। এর অন্যতম বড় কারণ তার উজ্জল ও নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি।


[ ] পশ্চিমবঙ্গের ভোটে কিছুটা হলেও হতোদ্যম কংগ্রেস কর্মীরা-

একুশের নির্বাচনী যুদ্ধে বাংলায় ভোট প্রচারে কংগ্রেসের সেরকম কোনও শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রচারে আসেননি। শুধু ১৪ এপ্রিল মাত্র একদিনের জন্য ভোট প্রচারে এসে রাহুল গান্ধী দুটি সভা করেছিলেন। বলতে গেলে অধীর চৌধুরী একা বিভিন্ন জায়গায় সভা করে বেড়াচ্ছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল কংগ্রেস কর্মীদের সমাবেশে তারকা প্রচারক হিসেবে দেখা যাচ্ছে সিপিআই(এম) নেতাদের। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মুর্শিদাবাদ এবং মালদার কংগ্রেস কর্মীরা অন্তত চেয়েছিলেন রাহুল গান্ধীর তাদের ওখানে ভোট প্রচারে আসুন। কিন্তু করোনার কারণে তিনি প্রচার বাতিল করায় কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকরা।


[ ] নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা সংকেত-

ভারত বিশ্বের তরুণতম দেশ। এই শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম সবকিছু একটু অন্যভাবে চিন্তা ভাবনা করে। তারা নিজেদের বিবেচনা মত সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই রাহুল গান্ধীর এই পদক্ষেপ ভারতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন ধারার সূচনা করবে। যেখানে নেতার অবদানের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে তার পদক্ষেপ এবং কর্মসূচি। এক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার জানিয়েছেন এই মুহূর্তে এক জায়গায় হাজারে-হাজারে মানুষের জড়ো হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বিপজ্জনক। স্বাভাবিকভাবেই রাহুল গান্ধী তার এই কর্মসূচি বাতিল করার মধ্য দিয়ে সেই বিপদের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কমালেন। যা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা ভারতে অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে দেখা দিতে পারে। শুরু করতে পারে আগামী প্রজন্মের রাজনীতির পথ চলা।