ভোজনরসিক বাঙ্গালীর কাছে খাদ্যই প্রান। খাবার দেখলে নিজদের সামলানো বড়ই দায়। দুপুরে গরম গরম ভাত আর কচি পাঠার মাংস থেকে রাতে চাইনিস কিংবা মোগলাই কোনটাই বাদ পড়ে না। যে কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া চিরকালের অভ্যেস।  তাতে যদি শরীরে অস্বস্তি বোধের সৃষ্টি হয় সে দিকে নজরও যায় না। বিয়ে হোক কিংবা পুজো প্রধান বিষয় কিন্তু খাওয়া-দাওয়া। তার সাথে কমপ্রোমাইস নৈবঃ নৈবঃ চঃ। শুধু কিন্তু অনেক তেল মশলা, বা অতিরিক্ত পরিমাণে ভাজাভুজি, বাইরের খাবার হতে যে  একমাত্র গ্যাস হয়, তাও নয় অনেকের আরও অন্যও কারনে গ্যাস হয়। আর এই গ্যাস থেকে অন্যান্য রোগেরও সৃষ্টি হতে পারে।  

গ্যাসের সমস্যা ভোগে না এমন লোককে খুঁজে পাওয়া দায়।  ব্যস্ত জীবনযাত্রার যুগে গ্যাস, অম্বল প্রায় ঘরোয়া রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনও ঘরে গেলেই আপনার চোখে গ্যাসের অন্তত এক পাতা ওষুধ অবশ্যই নজরে আসবে। কিন্তু এইভাবে গাদা গাদা গ্যাসের ওষুধ খেয়েও সমস্যা দূর হয় না উল্টে শরীরের অনেক সমস্যা দেখা যায়। তাই একটু ঘরোয় বা ভেষজ কিছু উপায়ে গ্যাস কে দূর করা বোধহয় সহজ ।  তাই গ্যাস থেকে কিভাবে আপনি মুক্তি পাবেন তারই সমন্ধে আজ জেনে নিন।

গ্যাসের নিরাময়ের বিষয় জানার আগে জেনে নিন গ্যাস কেন হয় ?

অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা গ্যাস হলেই অম্বল হবে বা অম্বল হলে গ্যাস হবে।  কিন্তু  বিষয়টি কিন্তু ভুল, এই দুইয়ের  মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। গ্যাস হলে অম্বল না-ও হতে পারে। গ্যাস হওয়ার কারণ ভিন্ন। প্রত্যেক দিন খাবার খাওয়ার সময়ে অনেক ফাইবার খাওয়া হয়। ইনটেস্টিনাল ব্যাকটিরিয়া বা এনজ়াইম যখন ফাইবার বার্ন করে, তখন বুদবুদের সৃষ্টি হয়। সেখান থেকেই গ্যাসের জন্ম।  আর সেটি গ্যাস আকারে মুখ দিয়ে বা পায়ুদ্বার দিয়ে নির্গত হয়।  

ঘরোয়া পদ্ধতিতে উপশমের উপায়

গ্যাস হলেই আমরা অনেক অ্যান্টাসিট, হজমের ঔষুধ খেয়ে থাকি, কিন্তু এর থেকে অনেক পার্শ প্রতিক্রিয়া হতে পারে তাই এই সকল বিষয়কে দূরে রেখে গ্রহন করুন কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি ও ভেষজ উপায়।

১.  কলা
প্রত্যকের ঘরেই কলা থাকে। তাই আপনার খাবারের রুটিনে কলা যোগ করে নিন। প্রতিদিন একটি করে কলা খেলেই আপনার আর কখনো গ্যাস-অম্বলের সমস্যা হবে না। করাণ কলাতে  থাকে  প্রচুর পটাশিয়াম এবং প্রাকৃতিক অ্যান্টাসিড যা এসিড রিফ্লাক্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকরূপে কাজ করে।

২. দারুচিনি
বেশিরভাগ হজমজনতি সমস্যার ওষুধ দারুচিনি। এতে আছে প্রাকৃতিক অ্যান্টাসিড যা হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায় এবং শোষণক্রিয়াকে শক্তিশালি করে। আধা চা চামচ দারুচিনি গুড়ো এক কাপ  জলে মিশিয়ে সেদ্ধ করে নিন। এরপর ঠাণ্ডা করে মিশ্রিত জলটি খেয়ে ফেলুন।  প্রতিদিন এভাবে তিনবার দারুচিনি মিশ্রিত জল খালিপেটে খেলে আপনি গ্যাসের সমস্যা থাকে মুক্তি পাবেন।

৩. পুদিনা পাতা
কয়েকটি পুদিনা পাতা কুচি কুচি করে একটি পাত্রে জল নিয়ে সেদ্ধ করে নিন। এরপর জলটা ছেঁকে ঠাণ্ডা করে  খেয়ে নিন। পুদিনা পাতা এসিড নিঃসরণের গতি কমায় এবং হজম ক্ষমতা বাড়ায়। এই পাতা এসিড রিফ্লাক্সের সঙ্গে বুক ব্যথা এবং জ্বালাপোড়া ভাবও কমায়।

৪. মৌরি জল
খাবার খাওয়ার পর এই মৌরি চিবিয়ে খেলে বদহজম এবং গ্যাস হয় না। রাতে শোবার আগে আধাকাপ জলে ২ চামচ মৌরি বীজ নিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন পরের দিন সকালে উঠে সেটি খেয়ে নিন এতে শরীর ঠান্ডা থাকে গ্যাস ও কম হয়।

৫. ডাবের জল
ডাবের জল পাকস্থলিতে শ্লেষ্মা উৎপাদনে সহায়ক। যা পাকস্থলিকে অতিরিক্ত গ্যাস সৃষ্টির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত ডাবের জল খেলে পান  শরীরের পিএইচ অ্যাসিডিক লেভেল ক্ষারীয় হয়ে যায়। ফলে গ্যাস-অম্বলের সমস্যা দূর হয়।

৬. ঠাণ্ডা দুধ
ঠাণ্ডা দুধ খেলে পাকস্থলির গ্যাস্ট্রিক এসিড স্থিতিশীল হয়ে আসে। দুধে আছে ক্যালসিয়াম যা পাকস্থলিতে এসিড তৈরি করতে প্রতিরোধ করে। সুতরাং অ্যাসিডিটির সমস্যা থেকে বাঁচতে খাবার তালিকার মধ্যে এক গ্লাস ঠাণ্ডা দুধ রাখুন।  

৭.জিরা
জিরার মধ্যে এমনকিছু এসেনশিয়াল অয়েল বা মৌলিক তেল রয়েছে যা স্যালিভারি গ্ল্যান্ডকে আরও সক্ষম করে। ফলে খাবার ভালো করে হজম হয় আর অতিরিক্ত গ্যাসও তৈরি হয় । জিরা আখের গুড়ের মধ্যে ভালো করে মিশিয়ে  ছোট ছোট বড়ি আঁকারে গড়ে নিন । দিনে তিনবার এর একটি করে বড়ি খেলে গ্যাস হেকে নিরাময় ঘটবে।

৮.ত্রিফলা
  ত্রিফলা গ্যাসের জন্যও খুব ভালো। পেট ঠান্ডা রাখতে ত্রিফলার জল অত্যন্ত উপকারী।  গবেষণায় দেখা গেছে, ত্রিফলা গ্যাস্ট্রিক আলসার হওয়ার প্রবণতা অনেক কমিয়ে দেয়।

৯.লেবুর রস
লেবু গ্যাস ও অম্বলের সমস্যা দূর করতে অত্যন্ত উপকারী। বেশী তৈলাক্ত, মশলাদার, খাবার খাবার পর  অনেক সময় হজমে সমস্যা হয় গ্যাস হয় সেই মুহুর্তে লেবু সঙ্গে সঙ্গে আরাম দেয়। এক কাপ জলে এক টেবিল চামচ লেবুর রস, হাফ চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে ভালো করে মিশিয়ে খাবার খাওয়ার পর খান নিয়ম করে। খুব উপকৃত হবেন।

১০. গোলমরিচ ও টকদই

 টক দইয়ে থাকা ক্যালসিয়াম  যা পাকস্থলীতে অ্যাসিড জমা হওয়া থেকে প্রতিরোধ করে। এর সঙ্গে গোলমরিচ যোগ করলে আরো ভালো ফল পাওয়া যাবে। টক দইয়ের ল্যাকটিক অ্যাসিড হজম প্রক্রিয়াকেও শক্তিশালী করে।

গ্যাসের সমস্যা নিরাময় করতে আনুন জীবনধারায় পরিবর্তন


১. রাতে খাওয়ার অন্তত এক থেকে দু’ ঘণ্টা পর ঘুমোতে যান। পারলে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটার অভ্যাস করুন।


২. একেবারে বেশী পরিমাণে খাবার না খেয়ে অল্প পরিমাণে বার বার করে খাওয়ার চেষ্টা করুন।


৩. প্রতিদিন অন্তত আধ ঘন্টা এক্সারসাইজ, যোগা করুন।

৪.অনেকক্ষণ খালি পেটে থাকবেন না। এতে গ্যাস ও অ্যাসিডিটি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। প্রতি দু’ঘন্টা অন্তর কিছু খাওয়ার চেষ্টা করুন।


৫. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন, কারণ- স্থূলতা হজমের সমস্যা হওয়ার একটি বড় কারণ।


৬. সারাদিনে ৩ থেকে ৪ লিটার জল পান করতে হবে। পারলে মাঝে মাঝে ইষৎ উষ্ণ জল খেতে পারেন।


৭. বাইরের অতিরিক্ত মশলাযুক্ত কিংবা তেলে ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন।


৮. পরিমিত পরিমাণে অ্যালকোহল খান এবং ধূমপান বর্জন করুন।


৯. দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে সবসময় মানসিকভাবে হালকা থাকার চেষ্টা করুন।

১০. বাঁধাকপি, ফুলকপি, পেঁয়াজ,  পালং শাক এই সকল খাবার যত কম খাওয়ার চেষ্টা করুন।