মহাভারত তথা সমগ্র পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারীর নাম হলো জনা।

> চরিত্রের উল্লেখ
জনার উল্লেখ আমি তিনটে জায়গা থেকে পেয়েছি। প্রথমত, বেদব্যাস এর শিষ্য ঋষি জৈমিনির ভারত সংহিতা তথা জৈমিনি ভারত।
দ্বিতীয়ত, কাশীরাম দাস এর বাংলায় অনূদিত মহাভারত।
তৃতীয়ত, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ” বিরঙ্গনা ” কাব্যের শেষ পত্র ” নীলধ্বজের প্রতি জনা “।

> চারিত্রিক বিবৃতি

জৈমিনি ভারতে জনার নাম ছিল “জ্বালা”। অর্জুন এবং প্রবীরের যুদ্ধে শরবিদ্ধ প্রবীরকে উদ্ধার করতে গিয়ে নীলধ্বজ যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন অর্জুনের সাথে। প্রবীর সেই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মারা যায়। নীলধ্বজ শেষ পর্যন্ত অগ্নির শরণাপন্ন হন। অগ্নি, নীলধ্বজকে বুঝিয়ে বলেন যে, অর্জুন আসলে নারায়ণের অবতার। নীলধ্বজ হতাশ হয়ে ফিরে এসে তাঁর স্ত্রী জ্বালাকে অশ্বমেধযজ্ঞের ঘোড়া ফিরিয়ে দিতে বলেন। স্বামীর সেই কথা পুত্রশোকে জর্জরিত ‘জ্বালা’ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি নীলধ্বজকে পুনরায় যুদ্ধে যাওয়ার পরামর্শ দেন। নীলধ্বজ তার কথা শুনে যুদ্ধে গেলেও তিরবিদ্ধ হয়ে ফিরে আসেন এবং জ্বালাকেই শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করেন। জ্বালা অবশেষে আগুনে আত্মাহুতি দেন এবং প্রাণনাশক বাণ হিসেবে চিত্রাঙ্গদা এবং অর্জুনের পুত্র বভ্রুবাহনের তূণের মধ্যে লুকিয়ে থাকেন।

নারী

কাশীরাম দাসের মহাভারতে সেই ‘ জ্বালা ‘ – র নাম হয়েছে জনা। এই মহাভারত অনুসারে নীলধ্বজ একবারও অস্ত্রধারণ বা যুদ্ধে অবতরণ করেননি। কিন্তু জনার চরিত্রের দাপট তো কমেনি, বরং আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন নারী হিসেবে, একজন মা হিসেবে তাঁর প্রতিশোধ স্পৃহা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখায় সেই মহীয়সী নারী স্থান পেয়েছেন ” বিরঙ্গণা ” রূপে। ” অঙ্গনা ” কথাটার অর্থ হলো ” নারী “। অর্থাৎ বীর যে নারী। এই নারী কোনো সম্মুখসমরে অংশ নেননি। কিন্তু তাঁর তেজোদীপ্ত প্রকৃতি, স্পষ্টভাষণ এবং সর্বোপরি আত্মমর্যাদা সহিত মাতৃত্ব তাকে সমস্ত চরিত্রের থেকে আলাদা করে তুলেছে। নীলধ্বজের পৌরুষ যেন জনার তেজের সামনে লুপ্ত হয়েছে নিমেষে। জনা যখন বুঝতে পারেন তাঁর স্বামী তাঁর পুত্রহন্তা শত্রুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেছেন, তিনি তাঁর স্বামীকে ধিক্কার জানিয়েছেন। অর্জুনের প্রতি নীলধ্বজের আতিথেয়তা দেখে জনার শরীরের ভেতরটা দগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। বিষাদে, অভিমানে, অপমানবোধে ফেটে পড়ছিলেন তিনি। নীলধ্বজের নীরবতা জনার তেজকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে ক্রমাগত। আত্ববিলাপে মর্মাহত হয়েও যখন তিনি নীলধ্বজের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে ব্যর্থ হলেন, নিজের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তিনি স্পষ্ট করে গেলেন, আত্মমর্যাদা ছাড়া বেঁচে থাকার থেকে তাঁর কাছে মৃত্যুবরণ অনেক সুখের। এরকম এক নারী আমার কাছে আদর্শের মতো। তাই বীরাঙ্গনা জনাই আমার সবচেয়ে প্রিয় পৌরাণিক চরিত্র।