১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কংগ্রেসের একাধিক রাজ্য স্তরের নেতারা দলত্যাগ করে তৃণমূলে যোগদান করেন। পরবর্তীতে আরও বেশ কিছু নেতা-নেত্রী কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে চলে আসে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস খুব দ্রুত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তারা কংগ্রেসের পরিসরটা দ্রুত দখল করে নেয়। তার ফলে পরবর্তীকালে আর‌ও একাধিক কংগ্রেস নেতা তৃণমুলকেই আগামী দিনের বিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যৎ মনে করে জোড়া ফুলের তলায় এসে সামিল হয়েছিল। প্রথমে যাদের ওপর নির্ভর করে দল গড়ে তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অনেকেই আজ আর তৃণমূলের সামনের সারিতে নেই। তাদের কেউ কেউ হয়তো মারা গিয়েছেন, আবার অনেকেই দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়ে নেতৃত্বে দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে।

images 1 11
Gulf News

২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সম্ভাব্য সমীকরণ এবং দল ভাঙার যোগ-বিয়োগের হিসাব কষতে, তখন আমরা বরং একটু পিছন ফিরে দেখি। খুঁজে দেখি একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপ কোন কোন তৃণমূল নেতারা দলের পিছনের সারিতে চলে গিয়েছিলেন বা আজও সেই জায়গায় অবস্থান করছেন।

১) পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়

২০০১ এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল এই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের পরিসর দখলে সক্ষম হলে পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরোধী দলনেতা হিসাবে নিযুক্ত করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টালিগঞ্জের এই বিধায়ক গোড়া থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন। সেই সময়ে নানা ইস্যুতে বিধানসভায় বামফ্রন্টের মন্ত্রীদের বেকায়দায় ফেলা নিয়ে তার বেশ ভালই সুনাম ছিল। যদিও দলের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোপে পড়ে তিনি খুব দ্রুত পিছনের সারিতে চলে যান। তার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কে যথেষ্ট অবনতি ঘটে। একসময়ের এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা সম্পূর্ণ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। সেই ভাবেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন তিনি। অসুস্থ হয়ে পড়ে বছরখানেক আগে প্রয়াত হন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এই অন্যতম প্রধান মুখ।

২) পরেশ পাল

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে তৈরি করেন সেই সময়ে তার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দলটাকে তৈরি করেছিলেন উত্তর কলকাতার দাপুটে নেতা পরেশ পাল। একসময়ে উত্তর কলকাতার তৃণমূলের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন শেষ কথা। বর্তমানে বেলেঘাটা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক হলেও এই মুহূর্তে তিনি দলে যথেষ্ট কোণঠাসা। তার বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা সাধন পান্ডে রাজ্যের অন্যতম দাপুটে মন্ত্রী হওয়ায় পরেশ পাল স্থানীয় রাজনীতিতে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তাকে দলের পক্ষ থেকেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়নি। এমনকি এই জল্পনাও রাজনৈতিক মহলে ঘুরে বেড়াচ্ছে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তাকে তৃণমূল আর প্রার্থী করবে না।

৩) গৌরীশঙ্কর দত্ত

দীর্ঘদিন নদীয়া জেলার তৃণমূল সভাপতি ছিলেন গৌরী শঙ্কর দত্ত। তার হাতে জেলার যাবতীয় দায়িত্ব ছেড়ে নিশ্চিন্তেই ছিলেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে নদীয়ার দুটি আসনেই খারাপ ফলাফল হয় তৃণমূলের। রানাঘাট কেন্দ্রটি বিজেপি তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, অন্যদিকে কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে মহুয়া মৈত্র তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করলেও জয়ের ব্যবধান অনেক কমে যায়। এরপরই দলের জেলা সভাপতির পদ থেকে এই বর্ষীয়ান নেতাকে সরিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের বর্তমানে জেলা নেতৃত্তের কাছে গৌরীশঙ্কর বাবু প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন।

৪) অশোক দেব

২০০১ এর বিধানসভা নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের সময় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের তৎকালীন কংগ্রেস বিধায়ক অশোক দেব রাতারাতি দল পরিবর্তন করে তৃণমূলে যোগদান করেন এবং তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে জিতে যান। তাকে একসময় বিধানসভার দলীয় সচেতক পদে নিযুক্ত করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আইনজীবী বিধায়কের যথেষ্ট দাপট ছিল একসময় দলে। বর্তমানে তৃণমূলের স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন তিনি। শোনা যাচ্ছে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তাকে আর টিকিট দেবে না দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

৫) মন্টুরাম পাখিরা

দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলের তৃণমূলের সংগঠন গড়ে তোলার মূল কৃতিত্ব দেওয়া হয় দীর্ঘদিনের বিধায়ক মন্টু রাম পাখিরাকে। তিনি সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকলেও জেলার বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয় বলে শোনা যায়। দলীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় তিনি দলের সর্বোচ্চ স্তরে আর খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছেন না বলে জানা গিয়েছে।

৬) রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়

কাটোয়া বিধানসভা কেন্দ্রের টানা তিনবারের কংগ্রেস বিধায়ক এবং কাটোয়া পুরসভার পৌর প্রধান রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় দল পরিবর্তন করে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। প্রথমদিকে কাটোয়ায় তিনি তৃণমূলের শেষকথা হয়ে থাকলেও তার বিরোধী শিবিরের নেতা অরিন্দম ভট্টাচার্য তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই গুরুত্ব কমতে শুরু করে এই বর্ষীয়ান নেতার। বর্তমানে তিনি দলের মধ্যে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। সম্ভবত আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিট পাবেন না তিনি।

images 2 11
The Week

৭) আরাবুল ইসলাম

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় আরাবুল ইসলামকে “দামাল ছেলে” বলেছিলেন। রাজ্যে সিপিআই(এম) এর প্রবল দাপটের সময়েও আরাবুলের দক্ষতার ওপর ভর করে ভাঙর বিধানসভা কেন্দ্র নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু পরবর্তীকালে একাধিক সমস্যায় জড়িয়ে জেলযাত্রা এবং দলের গোষ্ঠীর রাজনীতির কোপে পড়ে এই মুহূর্তে বেশ কোণঠাসা এই দাপুটে তৃণমূল নেতা। বর্তমানে তিনি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদে থাকলেও তার বিরোধী নেতা কাইজার আহমেদ ও নান্নু হোসেনের প্রভাব দলে অনেক বেশি।

৮) মদন মিত্র

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই কংগ্রেস ছেড়েছিলেন মদন মিত্র। মদনকে বরাবরই খুব স্নেহ করেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ কলকাতার এই দাপুটে তৃণমূল নেতা জেলে যাওয়ার পর থেকেই তার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মদন এখনো দলে থাকলেও তার আর সেই আগের প্রভাব নেই। বরং তিনি যথেষ্ট কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের মধ্যে।

তৃণমূল,
TC

৯) সোনালী গুহ

তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে পাশেই ছিলেন সোনালী গুহ। যাকে বলে হরিহর আত্মা, মমতা ও সোনালি তাই ছিলেন। যেখানে যেতেন সোনালী গুহকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের একেবারে শীর্ষস্তরে রাজনীতি করে আসা এই তৃণমূল নেত্রী দল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একটু একটু করে পিছনের সারিতে চলে যেতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে একাধিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এই প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ এই মুহূর্তে একেবারে অন্তরালে চলে গিয়েছেন। তাকে সেভাবে রাজনীতির ময়দানেও আজকাল আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।

১০) বিপ্লব মিত্র

জেলা সভাপতি হিসাবে দক্ষিণ দিনাজপুরের দায়িত্বে দীর্ঘদিন ছিলেন বিপ্লব মিত্র। তবে তার সঙ্গে বালুরঘাটের প্রাক্তন সাংসদ অর্পিতা ঘোষের দ্বন্দ্বের কথা সবাই জানতো। গত লোকসভা নির্বাচনে বিপ্লব শিবিরের অসহযোগিতার কারণে অর্পিতা ঘোষ বালুরঘাট থেকে হেরে গেলে এই লোকসভা কেন্দ্র তৃণমূলের হাতছাড়া হয়। তারপরেই বিপ্লব মিত্রকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন তৃণমূল সুপ্রিমো। এর কয়েকদিনের মধ্যেই দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন এই দাপুটে তৃণমূল নেতা। যদিও গেরুয়া শিবিরে মানাতে না পেরে কয়েক মাস পরে আবার “ঘরওয়াপসি” করে তৃণমূলের ফিরে আসেন বিপ্লব মিত্র। পুরানো দলে ফিরে আসলেও এখনো পর্যন্ত বেশ কোণঠাসা অবস্থাতেই আছেন তিনি।

আমরা এখানে কয়জন নেতার কথায় কেবলমাত্র আলোচনা করলাম। এছাড়াও আরও অজস্র দাপুটে তৃণমূল নেতা রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে এই মুহূর্তে দলের অভ্যন্তরে কোণঠাসা অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তাদের সবাই যে দলত্যাগ করে অন্য দলে নাম লেখানোর কথা ভাবছেন তা কিন্তু নয়। তবে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ভালো ফলাফল করতে হলে এই সমস্ত নেতাদের কাছে টেনে নেওয়া উচিত তৃণমূল নেতৃত্বের।