স্বাধীনতার পর ভারতের কৃষক শ্রেণী নানা বিষয় নিয়ে অনেকবারই  আন্দোলনে নেমেছে। কখনো তারা সফল হয়েছে আবার কখনো ব্যর্থ মনোরথে তাদের কাজে ফিরতে হয়েছে। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলতে সফল হয়েছে কৃষকরা। দেশের প্রতিটা কৃষক‌ই বোধহয় এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা তাদের এই আন্দোলনের চাপে বেশ বেকায়দায় পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তবে সরকারও এখনো পর্যন্ত নিজের সুর নরম করেনি। গতকাল সন্ধ্যেবেলায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কয়েকটি কৃষক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বেসরকারি আলোচনায় বসেছিলেন। সেখানে শাহ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন সরকার আইন প্রত্যাহার করবে না। অন্যদিকে কৃষক নেতারাও তাদের দাবিতে অনড় থাকেন। এই পরিস্থিতিতে আজ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কৃষি আইনে ৬ টি সংশোধনের প্রস্তাব আন্দোলনকারী কৃষকদের কাছে পাঠানো হবে। কৃষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সরকারের তরফ থেকে কৃষি আইনে সংশোধনীর প্রস্তাব আসার পর তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরবর্তী অবস্থান নির্ধারণ করবে।

এই মুহূর্তে কৃষক আন্দোলন একেবারে তিন মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে। এই তিনটি রাস্তার যেকোনো একটি রাস্তায় বাঁক নিতে পারে কৃষক আন্দোলন। আমরা বরং সেই তিনটে রাস্তায় একটু ভালো করে চোখ রাখি-

১) আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছতে পারে

কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি আইনে ৬ টা সংশোধনীর যে প্রস্তাব পাঠাবে আলোচনা করে মুহূর্তের মধ্যে তা খারিজ করে দিতে পারে কৃষক সংগঠনগুলি। সেইসঙ্গে তারা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত‌ও নিতে পারে। দিল্লি সীমান্তে গত দু’সপ্তাহ ধরে অবস্থান চালিয়ে আসা কৃষকরা সেক্ষেত্রে যাবতীয় নিষেধ ও বাধা অগ্রাহ্য করে দিল্লির ভেতরে ঢুকে গিয়ে সমস্ত জনজীবনকে স্তব্ধ করে দিতে পারে।

Farmers 11 20201206 402 602 571 855
Outlook India

কৃষক সংগঠনগুলি যদি এই সিদ্ধান্ত নেয় তাতে করে শুধু জনজীবন স্তব্ধ হবেনা, কেন্দ্রীয় সরকারের ভিত পর্যন্ত নড়ে যেতে পারে। এমনকি এই আন্দোলনের ব্যাপকতায় কেন্দ্রীয় সরকার পড়ে পর্যন্ত যেতে পারে, যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর আগে বিশেষ একটা দেখা যায়নি ।

২) প্রস্তাব মেনে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে পারে

কৃষকদের দাবি অনুযায়ী কৃষি আইন প্রত্যাহার করার ক্ষেত্রে সরকারের বিপদ নিয়ে গতকাল অমিত শাহ কৃষক নেতাদের বিস্তারিতভাবে বুঝিয়েছেন। তিনি জানান এই আইন প্রত্যাহার করলে গণতন্ত্রের পক্ষে একটা ভুল দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। এর ফলে পরবর্তীকালে নানান বিষয় নিয়ে আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে, যা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাছে কখনোই কাম্য নয়।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর এই অবস্থান থেকে বোঝা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার মূলত তাদের রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসেব করেই আইন প্রত্যাহার করতে চাইছেন না। অন্যদিকে কৃষক সংগঠনগুলি এতদিন ধরে আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় থেকেছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের লিখিতভাবে দেওয়া আইন সংশোধনের প্রস্তাব দুপক্ষের কাছেই “উইন উইন” সিচুয়েশন হয়ে দেখা দিতে পারে।

কেন্দ্রীয় সরকারের সংশোধনী প্রস্তাব মেনে নিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে পারে কৃষক সংগঠনগুলি। সেক্ষেত্রে তারা দাবী করতে পারে সরকার আইন প্রত্যাহারের রাজি না হলেও তাদের মূল দাবিগুলি মেনে নিয়েছে। এতে আন্দোলনকারী কৃষকদের‌ই জয় হয়েছে।

অন্যদিকে দেশের শাসক দল বিজেপি দাবি করতে পারে তারা কৃষকদের স্বার্থের কথা ভেবেই যে আইন প্রণয়ন করেছিল আন্দোলন প্রত্যাহারের মধ্যে দিয়ে কৃষকরা সেই বিষয়টিতেই সীলমোহর দিয়ে দিল।

images 7 3
Pledge Times

৩) আন্দোলনকারী কৃষকদের মধ্যে ভাঙন ধরতে পারে

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই আন্দোলনকারী কৃষকদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের আইন সংশোধনের প্রস্তাব কৃষক নেতৃত্তের একাংশ মেনে নিতে রাজি না হলেও অপর কিছু কৃষক সংগঠন তাতে সম্মত হয়ে যেতে পারে এবং আন্দোলন প্রত্যাহারেরকথা ঘোষণা করতে পারে। আর এটা যদি বাস্তবায়িত হয় সেক্ষেত্রে আন্দোলনকারী কৃষকদের মধ্যে ভাঙন ধরা অনিবার্য। একবার যদি আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর যায় তাহলে বাকি পরিস্থিতি সামলে নেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে খুব একটা সমস্যার হবে না। বরং কেন্দ্রীয় সরকার এবং শাসক দল বিজেপি প্রচার করতে পারবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একদল নেতা কৃষকদের ভুল বুঝিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে কৃষক নেতারা কৃষকদের দাবি দাবা নিয়ে প্রকৃতপক্ষে চিন্তিত ছিল তারা কেন্দ্রের সংশোধনী মেনে নিয়ে ইতিমধ্যেই আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে।

কৃষক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কোন পথে মোড় নেবে তা আজকের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে ধারণা করা যায় তবে পরিণতি যাই হোক না কেন এই কৃষক আন্দোলনের ব্যাপকতা আগের সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা দেশের সাধারন মানুষদের মধ্যেও এই প্রশ্ন জেগেছে যারা আমাদের মুখে খাবার তুলে দেয় তাদেরকে কেন রাস্তায় নেমে নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে হবে! কেন সরকার আরো সহানুভূতির সঙ্গে গোটা বিষয়টা দেখবে না ?