ভারতীয় জনতা পার্টির দীর্ঘ ৪০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত তাদের দল থেকে দুজন ব্যক্তি দেশের প্রধানমন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই দুজন হলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং নরেন্দ্র মোদি। এনাদের মধ্যে অটলবিহারী বাজপেয়ী দু’বছর আগে ১৬ আগস্ট ২০১৮ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রয়াত হন। অপরজন নরেন্দ্র মোদি বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এই দুই বিজেপি নেতা দেশের প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করলেও অনেকেই তাঁদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য খুঁজে পান। তারা মনে করেন একই রাজনৈতিক দল হলেও এই দুই নেতা সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করেন। আমরা মনে করি দৃষ্টিভঙ্গি ও শাসন প্রক্রিয়ায় এই দুই আমলের বিজেপির মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য সুস্পষ্ট। আসুন আমরা দেখি বাজপেয়ীর আমলের বিজেপির থেকে মোদির আমলের বিজেপি কতটা আলাদা।

১) জোট শরিকদের ওপর নির্ভরতা

সরকার পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বাজপেয়ীর বিজেপির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বিজেপির আকাশ-পাতাল ব্যবধান আছে। অটলবিহারি বাজপেয়ী মোট তিনবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রথমবার মাত্র ১৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। দ্বিতীয়বার ১৩ মাস এবং তৃতীয়বার পূর্ণ সময়ের অর্থাৎ ৫ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। তিনবারই তাকে শরিকদের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করতে হয়েছিল। তার আমলেই এনডিএ জোটের সূত্রপাত ঘটে। শরিকদের ওপর নির্ভর করে সরকার গড়ার ফলে তাকে অনেক বেশি মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে। এর ফলে বাজপেয়ীর পক্ষে বিজেপির সবকটি অ্যাজেন্ডা রূপায়ণ করা সম্ভব হয়নি।
নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হন।২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য তার সরকার ক্ষমতায় আসে। ঘটনা হচ্ছে এই দুবারই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতা লাভ করে। এর ফলে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে মোদির আমলে বিজেপিকে শরিকদের ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন পড়েনি। তাই তারা স্বাচ্ছন্দে নিজেদের অ্যাজেন্ডাগুলো রুপায়ন করার দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছে।

২) রাজনৈতিক সংস্কৃতি

অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং নরেন্দ্র মোদী দুজনেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই দুই নেতার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। হিন্দুত্ববাদী দল হলেও বাজপেয়ীর আমলে বিজেপি নেহেরু-গান্ধী ঘরানার রাজনৈতিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই কারণেই সেই সময় বিরোধীদের আপত্তিকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো বিজেপির পক্ষ থেকে।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদি নিজ নেহেরু-গান্ধী ঘরানার বাইরের রাজনীতিক হওয়ায় তিনি দলকে অনেক বেশি আগ্রাসী রাজনীতিতে অভ্যস্ত করে তুলেছেন বলে ধারণা করা হয়।

৩) আধিপত্যমূলক নীতি

অটলবিহারি বাজপেয়ী জোট শরিকদের অত্যন্ত বেশী গুরুত্ব দিতেন। তার আমলে কখনও পাঞ্জাবের শিরোমনি অকালি দল, বিহারের জেডি(ইউ) বা মহারাষ্ট্রের শিবসেনার মত দলগুলোকে টপকে রাজ্যস্তরে প্রধান শরিকে পরিণত হ‌ওয়ার বাসনা কাজ করেনি বিজেপির মধ্যে।
অথচ নরেন্দ্র মোদির আমলে দেশের সর্বত্র প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার তাগিদ লক্ষ্য করা যায় বিজেপির মধ্যে। যার ফলে বর্তমানে এনডিএ শরিকরা বিজেপিকে নিয়ে খুব একটা স্বস্তি অনুভব করেনা। তাদের মধ্যে সবসময় বিজেপির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কাজ করে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বিহারের নীতীশ কুমার নেতৃত্বাধীন জনতা দল ইউনাইটেড।

৪) সাংগঠনিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ

বাজপেয়ী আমলের বিজেপিতে সাংগঠনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছিল বলে মনে করা হয়।
যদিও নরেন্দ্র মোদির আমলে ঠিক এর উল্টো পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই আমলে বিজেপির রাজ্য কমিটিগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সব সময় তীক্ষ্ণ নজরদারি চালায়, যার ফলে স্থানীয় স্তরের বিজেপি নেতাদের অনেক সময়ই অস্বস্তিতে ভুগতে দেখা গিয়েছে।

৫) প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি

অটলবিহারি বাজপেয়ী কথার থেকে কাজ করায় বেশি আস্থা রাখতেন। তাই তার আমলে ভারতের প্রথম পারমানবিক বোমা পরীক্ষা করা সম্ভবপর হয়েছিল। সেই সঙ্গে তিনি কারগিল যুদ্ধে পাকিস্তানকে পর্যদুস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকলেও বাজপেয়ী বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে মূলত নেহেরুর জোট নিরপেক্ষ নীতিকেই অনুসরণ করেছিলেন।
নরেন্দ্র মোদি বারবার চীন ও পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার দাবি করলেও তার আমলেই চীন ও পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ ভারতীয় বাহিনী সেরকম কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ শিবির থেকে সরে এসে তিনি ভারতকে অনেক বেশি আমেরিকা ঘেঁষা দেশে পরিণত করেছেন।

অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে বিজেপি নেতারা চিরাচরিত বৈঠকি আমেজে দলের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করতেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির আমলে বিজেপি অনেক বেশি কর্পোরেট পদ্ধতিতে যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করে। বিজেপির দুই প্রজন্মের মধ্যে এটাই বোধ হয় মূল পার্থক্য।