১৯৭৭ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসকে পরাজিত করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করে বামপন্থী দলগুলোর জোট বামফ্রন্ট। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে পরাজিত হ‌ওয়ার আগে পর্যন্ত এই রাজ্যে টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করে মাত্র ৩০ টি আসনে জয় লাভ করতে সক্ষম হয় বামফ্রন্ট। যদিও পরবর্তীকালে তাদের বেশ কয়েকজন বিধায়ক দল বদলিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপিতে যোগদান করে।

২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক শক্তি ক্ষয় হয় বামেদের। রাজ্য জুড়ে তারা মাত্র ৭ শতাংশ ভোট পায়। রাজ্যের ৪২ টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৪১ টিতেই জামানত বাজেয়াপ্ত হয় বামফ্রন্ট প্রার্থীদের এবং তারা একটিও আসনে জয়লাভ করতে ব্যর্থ হয়। এই পরিস্থিতিতে ২০২১ এর বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা পুনর্দখল করা বামেদের পক্ষে কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। বিশেষত তৃণমূল ও বিজেপি উভয় দলের ওপর ক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা এই রাজ্যে খুব একটা কম নয়। যদিও সেই মানুষদের আস্থা অর্জন করতে হলে বামেদের বেশ অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। আসুন আমরা দেখি প্রধান কোন পাঁচটা জিনিস করলে এই রাজ্যের মানুষের আস্থা অর্জন করার মধ্যে দিয়ে বামেদের পক্ষে ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতে পারে।

১) প্রধান মুখ কে হবে তা দ্রুত ঠিক করা

যতই রাজনৈতিক দলগুলো বলার চেষ্টা করুক “ব্যক্তি নয় দল বড়”, সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু দলের মুখ “কে” সেটা অন্যতম প্রধান বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিমবঙ্গে বামেদের মূল সমস্যা হলো এই মুহূর্তে তাদের এমন কোনো জননেতা নেই যার গোটা রাজ্যব্যাপী প্রভাব আছে। এই ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে বামফ্রন্টের উচিত কোনো একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে তাদের মুখ নির্বাচিত করে যত দ্রুত সম্ভব লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়া। সেক্ষেত্রে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিকল্প হিসাবে ওই নেতাকে নিয়ে সাধারণ মানুষ ভাবনা চিন্তা করার সুযোগ পাবে, যা বামেদের পক্ষে লাভদায়ক হবে বলেই মনেহয়। অভিজ্ঞ মহম্মদ সেলিম বা শতরূপ ঘোষের মত তরুণ প্রজন্মের কোনো নেতাকে মুখ হিসাবে নির্বাচিত করতেই পারে বামফ্রন্ট।

২) ভরসাযোগ্য বিকল্প হয়ে ওঠা

পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূলের প্রতি বিরূপ এমন মানুষদের কাছে এই মুহূর্তে প্রধান বিকল্প হয়ে উঠেছে বিজেপি। বাম সমর্থকদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা তৃণমূলকে হারানোর জন্য বিজেপিকে ভোট দেবার কথা চিন্তা ভাবনা করছেন। এদের কাছে তৃণমূলকে হারানোই প্রথম লক্ষ্য। আবার বিজেপিকে আটকানোর জন্য বামেদের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার কথা চিন্তা ভাবনা করছেন এরকম মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তারা মনে করছেন বিজেপিকে আটকানোর ক্ষমতা বামফ্রন্টের নেই। ঘটনা হল এই দুই ধরনের মানুষ‌ই অতীতে বামফ্রন্টকে ভোট দিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে বামেদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত তারা যে একত্রে তৃণমূল ও বিজেপি এই দুই শক্তিকেই পরাজিত করে রাজ্যের ক্ষমতায় আসতে সক্ষম, এই বিশ্বাস মানুষের মধ্যে তৈরির চেষ্টা করা।

৩) রাজ্যব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা

অনেকেই অভিযোগ করেন বর্তমানে বামেদের সমস্ত আন্দোলন কলকাতা কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। এই অভিযোগকে ভুল প্রমাণিত করতে এবং আগামী বিধানসভা নির্বাচনকে মূল লক্ষ্য বানিয়ে বামফ্রন্ট নেতা ও কর্মীদের উচিত যত দ্রুত সম্ভব রাজ্যের প্রতিটা বিধানসভা কেন্দ্রে মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে গড়ে তোলা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা গিয়েছে গণআন্দোলন গড়ে তোলার মধ্যে দিয়েই এই রাজ্যের ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হয়। গণআন্দোলন গড়ে তুলতে মাঝেমধ্যে দু-একটা মিছিল-সমাবেশ করলে হবে না, লাগাতার রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে মানুষের দাবি দাওয়া আদায় করে নিতে হবে। তাহলেই মানুষ ভরসা করতে শুরু করবে বামেদের ওপর।

৪) শ্রমজীবী ক্যান্টিন ও শ্রমজীবী বাজারকে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে

লকডাউনের সময় থেকে বামেদের চালু করা শ্রমজীবী ক্যান্টিন গরীব ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। শ্রমজীবী বাজারের মাধ্যমে বাজারদরের থেকে বেশ অনেকটা কম দামে সবজি বিক্রি হওয়ার ফলে তা সাধারণ মানুষক অনেকটাই স্বস্তি দিয়েছে। বামেদের প্রতি সাধারণ মানুষের এই সমর্থনসূচক মনোভাবকে ভোটে পরিণত করতে হলে তাদের উচিত রাজ্যের প্রতিটা বিধানসভা কেন্দ্রে অন্তত একটি করে শ্রমজীবী ক্যান্টিন ও শ্রমজীবী বাজার গড়ে তোলা।

৫) দ্রুত বিকল্প নীতি ঠিক করা

তৃণমূলের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র দুর্নীতির অভিযোগ এবং বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার অভিযোগ তুলে বিধানসভা ভোটের বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব হবেনা বামেদের পক্ষে। এর জন্য প্রয়োজন নিজেদের বিকল্প নীতি ও পরিকল্পনা যত দ্রুত সম্ভব জনগণের সামনে নিয়ে আসা। কারণ শুধু সমালোচনা করে রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষের আস্থা অর্জন করা কঠিন। বর্তমান সময়ে মানুষের মূল চাহিদা হল কাউকে ভোট দিয়ে সে আগামী দিনে কী কী পাবে। তাই রাজ্যের ক্ষমতায় আসলে বামেদের কাছ থেকে রাজ্যের মানুষ কী কী সুবিধা পাবে এবং আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গকে তারা কোন পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তা মানুষের সামনে দ্রুত তুলে ধরা উচিত বাম নেতৃত্তের।

রাজনীতির মাঠে ময়দানের লড়াই কোনো তত্ত্ব কথার ওপর ভিত্তি করে হয় না। তবে ওপরের বিষয়গুলো যদি বাম নেতৃত্ব দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত প্রয়োগ করে, তাহলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে তারাই হবে অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ।