কৈশোরে পরিচিতদের সঙ্গে মিলে একটা ব্যান্ড গড়ে তুলেছিল ছেলেটা, নাম ছিল “হবোকেন ফোর”। বয়স তখন বছর কুড়ি হবে, স্থানীয় রেডিও স্টেশনের আয়োজিত এক অপেশাদার সংগীত প্রতিযোগিতায় জিতে গেল তাদের এই ব্যান্ডটি। তারপর দেশ জোড়া সঙ্গীত সফরের সুযোগ এসে গেল তাদের কাছে। শুরু হলো যাত্রা। গান গাওয়ার সুযোগে সারাদেশ ঘোরা যাবে, এটা বাকিদের কাছে মুখ্য হলেও এই ছেলেটি কিন্তু অন্যরকম কিছু ভাবছিল। সে তখন থেকেই সংগীতকে তার জীবনের মূলমন্ত্র করে তোলার ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছে।  সে এই সুযোগটাকে মনে করেছিল তার লক্ষ্যে পা রাখার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ।

এই কিশোর পরবর্তীতে সংগীত দুনিয়ার এক মাইলফলকে পরিণত হবে। সেইসঙ্গে তার অভিনয় দক্ষতার ঝলকানি চোখ ধাঁধিয়ে দেবে মানুষকে। তার সাফল্য বুঝতে গেলে একটা তথ্যই যথেষ্ট, গ্র্যামী ও একাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার পুরস্কার) এই দুই তার বাড়ির শোকেসে শোভা পাচ্ছে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা’র কথা বলছি।

images 39 2
Today in History

• জন্ম :

১৯১৫ সালে আজকের দিনে (১২ ডিসেম্বর) আমেরিকার নিউ জার্সিতে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। তার জন্ম হয়েছিল এক ইতালিয়ান সচ্ছল উদ্বাস্তু পরিবারে। তার বাবা মার্টিন সিনাত্রার ছিল সরাইখানার ব্যবসা। বেশ ভালই চলত সরাইখানা। এছাড়াও তিনি একজন “প্রাইজ ফাইটার” ছিলেন। অর্থ বাজি রেখে যে সমস্ত বক্সাররা লড়াই করতো তাদের প্রাইজ ফাইটার বলা হয়। তার মা নাতালিয়া স্থানীয় স্তরের একজন সুপরিচিত রাজনীতিক ছিলেন। তিনি আমেরিকার ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য এবং অর্থ সংগ্রাহক ছিলেন। মায়ের ভূমিকা ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার জীবনে বিপুল। তিনি পেশাদার সংগীত শিল্পী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তার মা তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিলেন।

সংগীতশিল্পী হিসাবে জীবন শুরু করার প্রথম দিকে সিনাত্রা তার সেই সময়কার আইডল বিং ক্রসবির সঙ্গে একই ব্যান্ডে কাজ করার সুযোগ পান। পরবর্তীকালে তিনি স্বীকার করেছিলেন এই সুযোগ তাকে পরিপূর্ণ সংগীতশিল্পী রূপে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। কয়েক বছর পর তিনি আর এক বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী টমি ডর্সির ব্যান্ডে যোগ দেন। বছর কয়েক সেখানে চুটিয়ে গান গাওয়ার পর স্বাধীন পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক করেন একক সংগীতশিল্পী হিসাবে কাজ করবেন। তার সেই সিদ্ধান্ত যে কতটা সঠিক ছিল তা খুব দ্রুত প্রমাণ পায় গোটা বিশ্ব।

images 40 2
Pinterest

• পথ চলা শুরু :

১৯৪৪ সালে ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা কলম্বিয়া রেকর্ডসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এই বছরেই তার প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তিনি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছন দ্যা ভয়েজ অফ ফ্রান্স সিনাত্রা  অ্যালবামটি প্রকাশিত হওয়ার পর। ১৯৪৪-৫২ পর্যন্ত সময়কাল তার জীবনে “কলম্বিয়া অধ্যায়” নামে সুপরিচিত। তার এই বিপুল সাফল্য চলে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। এইসময় সিনাত্রার গাওয়া একের পর এক গানে গোটা দেশ মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল। তার সেই সব গান তৈরির পেছনে অন্যতম অবদান ছিল কম্পোজার আলেক্স স্টরডলের। টমি ডর্সির ব্যান্ডে যখন কাজ করতেন তখন আলেক্সের সঙ্গে পরিচয় হয় সিনাত্রার। খুব দ্রুত তারা একে অপরকে বুঝে যান। সিনাত্রা বুঝেছিলেন তার তৈরি অনবদ্য গানগুলিতে আলেক্স‌ই যথাযথ সুর দিতে পারবে।

পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে ভাঁটার টান আসে তার কেরিয়ারে। ১৯৫৩ সালে নতুন অবতারে দেখা দেন তিনি। ফিরে আসেন অভিনেতা হিসাবে। ফ্রম হিয়ার টু ইটার্নিটি সিনেমায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আবার জয়যাত্রা শুরু হয় সিনাত্রার। এই সিনেমাটিতে অভিনয় করার জন্য তিনি সেরা সহ-অভিনেতার অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পান। সেইসঙ্গে গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার‌ও পেয়েছিলেন। এরপর সমানতালে তার গায়ক ও অভিনয় জীবন এগিয়ে নিয়ে যান তিনি। পরবর্তীতে প্রযোজকের ভূমিকাও পালন করেছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী। জীবনে ৫ টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পান তিনি যা তার সাফল্য এবং সঙ্গীত দুনিয়ায় প্রভাবের পরিচয় স্বরূপ। তিনি টেলিভিশনেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।

images 41 2
Pinterest

সঙ্গীত দুনিয়া পপ গানের ক্ষেত্রে পথিকৃত বলে মনে করা হয় ফ্রাঙ্ক সিনাত্রাকে। সঙ্গীত দুনিয়ায় তিনি যে পথ চলা শুরু করেছিলেন তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এলভিস প্রেসলি মাইকেল জ্যাকসনরা। তার পৃথিবীবিখ্যাত এ্যালবামগুলি হল সং ফর সুইংগিন লাভার্স! , কাম ফ্লাই উইথ মি, অনলি দ্যা লোনলি, নাইস “এন” ইজি, ইন দ্যা উই স্মল আওয়ার্স। তাকে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী হিসাবে আজও সম্মান জানানো হয়। এই প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পীর গানের অ্যালবাম বিক্রি হয়েছে ১৫০ মিলিয়ন ! এই বিপুল সংখ্যক রেকর্ডিংয়ের বিক্রি প্রমাণ করে সঙ্গীত দুনিয়াকে সিনাত্রার গান কি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। কয়েক প্রজন্মের সঙ্গীত নিয়ে যাবতীয় পছন্দ-অপছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল তার গাওয়া প্রতিটি গান।

তার অভিনীত বিখ্যাত সিনেমা গুলি হল- দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন আর্ম, দ্য মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট, গাইজ এন্ড ডলস, অন ধর্ম টাউন, হাই সোসাইটি, পাল জোই। দ্য মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট এবং পাল জোই এই দুই চলচ্চিত্রে তার অভিনয় ব্যাপকভাবে আলোড়ন তোলে চলচ্চিত্র প্রেমীদের মনে। টিভিতে তার সঞ্চালিত দ্য ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা শো দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলেছিল।

images 42 2
Wikipedia

• ব্যক্তিগত জীবন :

ব্যক্তিগত জীবন নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলো এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর। ২৪ বছর বয়সে প্রথমবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ে করেন দীর্ঘদিনের বান্ধবী ন্যান্সি বারবোতাকে। তাদের দাম্পত্য জীবন ১১ বছর স্থায়ী হয়। এই সময়ের মধ্যেই তিনটি সন্তানের জন্ম হয় সিনাত্রার। ন্যান্সি সিনাত্রা, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা জুনিয়র এবং টিনা সিনাত্রা হলেন তার এই তিন সন্তান। পরবর্তীকালে আরও তিনবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। আভা গার্ডনার, মিয়া ফ্যারোর পর চতুর্থবারের জন্য বিয়ে করেন বারবারা মার্ক্সকে।

ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা বরাবরই আমেরিকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার মায়ের সূত্রে তিনি প্রথম থেকেই ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থক। জন এফ কেনেডির হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রচার করেছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে তিনি রিপাবলিকান দলের প্রতি সমর্থন জানান। রোনাল্ড রেগনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সখ্যতা পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল।

৯০ এর দশকের প্রথম দিকে পর্যন্ত কাজ করে গিয়েছেন ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা। তারপর দীর্ঘ ছয় দশকের কর্ম জীবন থেকে অবসর নেন তিনি। এই সময় পরিবারের সঙ্গেই পুরো সময়টা কাটাতেন। ১৯৯৭ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ এক বছর যাবৎ রোগভোগের পর হাজার ১৯৯৮ সালের ১৪ মে প্রয়াত হন এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী।

তিনি না থাকলেও তার গানগুলি আজও একই রকম ভাবে দোলা দিয়ে যায় আমাদের মনে। সেই গানগুলির মধ্যে দিয়েই সব সময়ের জন্য আমাদের সঙ্গে থেকে গিয়েছেন ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা।