” নর্থে যাবি? ”
সপ্তমীতে এমন একটা প্রস্তাব খুবই প্রত্যাশিত। কানে কানে Darshan Raval এর সাথে তখন একটু দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছিলাম। ” হ্যাঁ ” কথাটা বলতে গিয়ে বার বার আটকে যাচ্ছিলাম। কলকাতার পুজো মানেই একটা পরিচিত উল্লাস চারিদিকে। আর পরিচিত কিছু মানেই তার সাথে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি। বিগত চার বছরে গড়ে তোলা স্মৃতিগুলো এখনও যে বড্ড স্পষ্ট, একটা সদ্য হওয়া ক্ষতের মতো। কেমন অস্থির আমার ভেতরটা তখন।
নর্থ। বনেদি স্মৃতি। শোভাবাজার রাজবাড়ির ভেতরটা প্রথমবার দেখতে যাওয়া। সেই অজান্তেই রাজবাড়ীতে ঢুকে পরা। তারপর হঠাৎ খুব ভালো লেগে যাওয়া। একটা জায়গায় গেছিলাম মনে পড়ে, সেটাও একটা রাজবাড়ি। নামটা মনে পড়ছেনা এই মুহূর্তে। ওখানে পালা করে পুজো হয়। মানে একটা রাজবাড়ীর পালা ১৩ বছর অন্তর অন্তর আসে। আরেকটা অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য ছিল সেই পুজোর। ডানদিকে গণেশ আর বামদিকে কার্তিকের স্থান তাদের বিশেষ বিগ্রহে। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক কিন্তু সত্যি। সেই পুজোয় যদি আবার অজান্তেই পৌঁছে যাই? এসব আশঙ্কা আমায় সম্মতি থেকে দশ হাত দূরে রাখছে।
পাড়ার মণ্ডপের দিকটা একটু গেলাম, দেখলাম ঠাকুর মশাই বলছেন, ” এবার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে মায়ের “। মূর্তির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম, মূর্তিটাও একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমাদের দুজনের পরিস্থিতিতে খুব একটা পার্থক্য নেই। দুজনেরই অস্তিত্ব আছে, কিন্তু প্রাণ বন্ততা নেই। মাঝে মাঝে চোখের নিচটা ভিজেছে কিনা হাত দিয়ে দেখতে হচ্ছে, এই যা। কিছু আতপ চাল আর কুচো ফুল দিয়ে কিভাবে একটা মূর্তিতে কেউ প্রাণ ফেরাতে পারে? আর যদি ফিরিয়েও দেয়, তারা তো অবতারের সমান। নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে একেই কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। আচ্ছা, স্বপ্ন পূরণ না হলে কি প্রাণ ফেরে? এমনিতেই স্বপ্নের আকার দিনে দিনে বাস্তবের ছোঁয়ায় ছোটো হয়ে আসে। তার পরও যদি সেটা পূরণ না হয়, তাহলে তো একটা জীবন্ত লাশের মতোই বেঁচে থাকা, তাই না? আমাদের দেহে প্রাণ ফেরায় আমাদের কাছের মানুষজন, আমাদের ভালোবাসার মানুষজন।
জীবনের লক্ষ্যগুলো একসময় যাযাবর হয়ে যায়। তাও যেনো আমরা একটা ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই নিজেদের মধ্যে। ভালো থাকার ইচ্ছে। কিন্তু যারা আমাদের সত্যিকারের ভালো রাখতে পারে, তাদের কাউকে যখন হঠাৎ হারিয়ে ফেলি, জীবনে কেমন কেনো একটা গরমিল চলে আসে। হঠাৎ, সব ছেড়ে দিয়ে দূরে কোথাও লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এমন সময় মণ্ডপের পাশে থাকা ছোটো ছোটো বাড়িগুলোর একটা থেকে আর্তনাদের মতো কান্না ভেসে এলো। শুনতে পেলাম আমার বয়সী একটা ছেলের মা মারা গেলো। ছেলেটা নাকি পাথরের মতো হয়ে গেছে। এদিকে ঠাকুর মশাই বেশ্যা পাড়ার মাটির খুঁজে পাচ্ছেন না বলে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
একটা ৫ মিনিটের ঘটনা আর আমি যেনো সবটা বুঝে গেলাম। বুঝে গেলাম আমাদের প্রাণ ফেরে তাদের ছোঁয়া পেলে যারা আমাদের থেকেও বেশি মৃত।