বিধানসভা নির্বাচনে নবমীর রাত সোমবার। ২৯ এপ্রিল অষ্টম দফার ভোট আসলে দশমীর বিসর্জনের সুর। ঐদিন গেলেই যার জন্য এত আয়োজন, এত বিতর্ক সেই বিধানসভা নির্বাচনের ভোট পর্ব সমাপ্ত হবে। ২ মে ভোটের ফল প্রকাশের দিন তাকে তুলনা করা যেতে পারে স্কুলের পরীক্ষার বার্ষিক ফল প্রকাশের দিনের সঙ্গে। তাই নবমীর রাতে আমরা যেমন গোটা পুজো কেমন কাটলো তার একটা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসি, ঠিক সেরকমই আজ আমরা খুঁজে দেখব সপ্তম দফার ভোট পর্ব মিটে যাওয়ার পর ঠিক কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উঠে আসছে রাজ্য রাজনীতিতে। তবে শুধু রাজনীতির ময়দানেই বিশ্লেষণ আটকে রাখা সমীচীন কাজ হবে না। সার্বিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ, সার্বিকভাবে এই বাংলায় বসবাসরত বাঙালির ওপর এই বিধানসভা নির্বাচনের কি প্রভাব পড়তে চলেছে সেটা একটু উঁকি মেরে দেখা যাক।


[ ] মমতার পর দ্বিতীয় জননেত্রী পেয়ে গিয়েছে রাজ্যবাসী-

বাঙালি যতই সমানাধিকারের কথা বলুক পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বরাবরই পুরুষতান্ত্রিক। সব পক্ষেরই শীর্ষাসনগুলি দখল করে থেকেছে পুরুষেরা। সেই রীতি সাহসের সঙ্গে প্রথম ভাঙতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরের ঘটনা শুধুমাত্র এরাজ্যের নয়, গোটা দেশের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে। এবার দ্বিতীয় জননেত্রীর উদ্ভব হয়েছে পুরুষপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতির পরিসরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেই নন্দীগ্রামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সিপিআই(এম) প্রার্থী মীনাক্ষী মুখার্জি। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বাম শিবিরে তার যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে তা প্রমাণ করে দিয়েছে পুরুষদের দখলে থাকা আলিমুদ্দিনে এবার থাবা বসাতে চলেছেন এই তরুণ প্রজন্মের নেত্রী। সার্বিকভাবেই তাকে সামনে রেখে আগামী দিনে এগিয়ে গেলে বামেদের ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।


[ ] মমতাই তৃণমূলের সব, অভিষেক ফ্যাক্টর নয়-

জোড়া ফুল শিবিরের বিরুদ্ধে রাজ্যের সাধারণ মানুষের যে বিপুল পরিমাণ ক্ষোভ তাতে তৃণমূলের এবারে সর্বত্র উড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই দলটির সুপ্রিমোর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার প্রতি রাজ্যের সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও আস্থা আজও অটুট। এবারের নির্বাচনের পর তৃণমূল সরকার গড়তে পারুক বা না পারুক তারা যা ভোট পাবে সবটাই মূলত দলনেত্রীর কল্যাণে। এবারের নির্বাচনে এটাও প্রমাণ হয়ে গিয়েছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যতই দলের অভ্যন্তরে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন না কেন আম জনতার কাছে তার তেমন কোনও গুরুত্ব নেই। তাকে দেখে সাধারণ মানুষ তৃণমূলকে ভোট দেবে বলে মনে হয় না। তাই যতদিন মমতা আছেন ততদিন অভিষেকের অবস্থানও সুরক্ষিত থাকবে। এটাও ঘটনা তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতারা মূলত মমতার কারণেই রাজনীতিটা করেন। অভিষেকের সঙ্গে তাদের বেশিরভাগেরই সম্পর্ক ভালো নয়।


[ ] অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হতে পারে বিজেপির-

২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে একের পর এক চমকে দেওয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিধানসভা ভোটের আগে শক্তির বিচারে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল বিজেপি। কিন্তু অত্যধিক পরিমাণে ভিন রাজ্য থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে এসে বাংলার ভোট প্রচারে সামিল করার ফলে তাদের হিসেবটা অনেকটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। ভিন রাজ্যের নেতারা পশ্চিমবঙ্গের ভোট প্রচারে অনেকদিন ধরেই আসেন। কিন্তু বিজেপি এবারে যেভাবে বাইরের রাজ্যের নেতাদের দিয়ে প্রচারের কার্পেট বম্বিং করেছে তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গবাসী খুব একটা পরিচিত নয়। এটা পরিষ্কার সাধারণ মানুষ এই ঘটনাকে খুব একটা ভাল নজরে দেখেনি। সত্যি বলতে নরেন্দ্র মোদির সমাবেশ বাদ দিলে বিজেপির বাকি সব কেন্দ্রীয় নেতাদের সভায় অনেক সময়ই সাধারণ মানুষের উপস্থিতির সংখ্যা মাথা গুণে বের করে ফেলা সম্ভব হবে। এই পরিস্থিতিতে বাইরের রাজ্য থেকে নেতাদের এনে বিজেপির এই ভোটের লড়াই শেষ পর্যন্ত তাদের যাত্রাভঙ্গ করতে পারে।


[ ] বাংলার দল নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নয় কংগ্রেস হাইকমান্ড-

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের সঙ্গে জোট গঠন করে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসার লড়াই চালাচ্ছে। যদিও বিষয়টি কংগ্রেস হাইকমান্ডকে দেখলে কোনমতেই বোঝা সম্ভব নয়। রাহুল গান্ধী মাত্র একদিন ভোট প্রচারে বাংলায় এসেছিলেন। এছাড়া কংগ্রেসের আর কোন‌ও শীর্ষস্থানীয় জাতীয় নেতা এ রাজ্যে ভোট প্রচারে আসেননি। তাদের এই মনোভাব পরিষ্কার করে দিয়েছে বাংলার দল নিয়ে খুব একটা আশার আলো দেখছেন না রাহুল-প্রিয়াঙ্কা। সে জন্যই সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের ভোট প্রচার এড়িয়ে গিয়ে মুখ রক্ষা করার নীতি নিয়েছেন তারা।


[ ] আব্বাস সিদ্দিকী রাজনীতির ময়দানে থেকে যাওয়ার জন্যই এসেছেন-

ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর রাজনীতিতে নামাটা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। তাদের মনে হয়েছিল এই ধর্মীয় নেতা আসলে নিজের সম্প্রদায়ের ভোট একত্রিত করে দর কষাকষির রাজনীতিতে নেমেছেন। যদিও নির্বাচনের সময় একের পর এক বক্তৃতায় এই তরুণ ধর্মীয় নেতার যে চিন্তাভাবনার ছাপ পাওয়া গিয়েছে তা বাংলায় অত্যন্ত বিরল। আব্বাস যদি তার নিজের এই অবস্থান ধরে রাখেন সে ক্ষেত্রে তার হাত ধরে মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই অনেকদূর পৌঁছে যাবেন। সেইসঙ্গে অত্যন্ত শিক্ষণীয় বিষয় হল একটিও নির্বাচনী সমাবেশে ধর্ম নিয়ে কোন‌ওকথা বলেননি আব্বাস। যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে রাজনীতি করার অন্যতম সহায়ক।


[ ] বাঙালির কাছে রবীন্দ্র-নজরুল আজ আর ততটা প্রিয় নয়-

এবারের ভোটে দেখা গিয়েছে তরুণ প্রজন্মের একটা বড়ো অংশ নানা কারণে বিজেপি সমর্থক। তাদের মধ্যে অনেকেই রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে নিয়ে আর ততটা আগ্রহী নয়। শুধুমাত্র তাই নয় তারা বাঙালির গর্বের ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করে দেন। অবলীলায় বরং তাদের কাছে তথাকথিত ধর্মীয় ঐতিহ্য অনেক বেশি আপন। তাই বাঙালির স্বাভাবিক গতি ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে এই ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তন হওয়ার সময় এবার এসে গিয়েছে।


[ ] রাজনীতিকে কেরিয়ারের আরেকটি ‘অপশন মাত্র’ মনে করেন তারকাদের একাংশ-

এবারের বিধানসভা নির্বাচন প্রমাণ করে দিল টলিউড তারকাদের একটা বড়ো অংশ ডামাডোলের বাজারে নতুন একটি ক্ষেত্রে ভাগ্য পরীক্ষায় নেমেছেন। মুশকিল হচ্ছে তারকাদের এই অংশটির অনেকেই রাজনৈতিক বোধের দিক দিয়ে ন্যূনতম সচেতন নন। তাদের কাছে যা বিজেপি তাই তৃণমূল তাই কংগ্রেস তাই সিপিআই(এম)। এরা কেবলমাত্র ক্ষমতা বোঝেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত সস্তা লাভের পথ ছেড়ে এই তারকাদের সার্বিকভাবে বর্জন করা। তাহলে কি অভিনেতারা ভোটের লড়াইয়ে নামতে পারবেন না? তেমন নয়। কিন্তু দেব, দেবদূত ঘোষ, বাদশা মৈত্র এর মত মানুষরা অবশ্যই রাজনীতির ময়দানে স্বাগত। এরা প্রকৃতপক্ষে মানুষের পাশে যেমন থাকেন, তেমনই নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান সম্বন্ধে অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণা পোষণ করেন। ‘কিন্তু মনে হল তাই ভোটে দাঁড়িয়ে পড়লাম’ এ রকম মানুষজনদের থেকে রাজনৈতিক পরিসরকে রক্ষা করা জরুরি।


[ ] আগামী কিছু বছর বিভাজনের রাজনীতি বাংলার ভবিষ্যৎ-

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে সমাজের সর্বস্তরে যেভাবে বিভাজনের বীজ বপন করা হয়েছে তাতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন এই বিষ পান করেই তাদের আগামী বেশ কিছুদিন হাঁটতে হবে। আমরা বরং সাময়িক লাভালাভের হিসেব ছেড়ে এটুকু সচেতন হ‌ই যাতে আগামী দিনে আর এই বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে পড়তে না পারে।