ভারতীয় সংবিধানের মূল রূপকার ড: ভিমরাও বাবাসাহেব আম্বেদকার ১৪ এপ্রিল ১৮৯১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম হয় এক মারাঠি মাহার জাতিভুক্ত পরিবারে। ওই সময় মাহার জাতির মানুষেরা হিন্দুদের মধ্যে নিম্ন শ্রেণী হিসাবে পরিচিত ছিল। তার ফলে বেড়ে ওঠার সময় ভিমরাওকে অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। বরাবরের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনোই আর পাঁচজন ছাত্রের সঙ্গে একই আসনে বসার সুযোগ পাননি। তাকে শ্রেণীকক্ষের বাইরে মেঝেতে বসে ক্লাস করতে হতো। তিনি ছিলেন তপশিলি জাতিভুক্ত প্রথম ভারতীয় মাস্টার ডিগ্রি প্রাপ্ত ব্যক্তি। প্রথম ভারতীয় হিসাবে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে পিএইচডি ডিগ্রী পান ভিমরাও আম্বেদকার।

একাধারে আইনের ডিগ্রিধারী অন্যদিকে অর্থনীতি ও সমাজ নীতিতে প্রবল‌ ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন আম্বেদকার‌ই বোধহয় সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার কাজ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে। তার কার্যকলাপ সংবিধান রচনা ও আইনি ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং এগুলিতে তিনি তার জীবনের যতটুকু সময় ব্যয় করেছিলেন, তার থেকেও অনেক বেশি সময় ও মনঃসংযোগ ব্যয় করেছিলেন সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের উন্নতি ও তাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে।

images 20 1
Adobe stock



তিনি নিজে তপশিলি জাতিভুক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় তাদের যন্ত্রণা ও অসুবিধাগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। একই সঙ্গে ছিলেন প্রবল জ্ঞান ও মেধার অধিকারী। তাকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি বলেও অভিহিত করেছেন অনেকে। মনে করা হয় পৃথিবীর প্রথম ১০০ জন জ্ঞানী ও মেধাবী ব্যক্তির মধ্যে আম্বেদকর একজন। তার যাবতীয় জ্ঞান ও মেধা নিয়ে আসূয়ায় না ভুগে তিনি তা জনসেবা ও মানব কল্যাণের কাজে নিয়োজিত করেন।

একই সঙ্গে প্রবল বিদ্রোহী আম্বেদকার মুহূর্তের সিদ্ধান্তে নিজে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং জাতপাত বিহীন সমাজ গড়তে অসংখ্য মানুষকে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করে তুলেছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি তার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো হীনমন্যতায় ভোগেননি। বরং তাকে হাতিয়ার করে তুলেছিলেন জাতপাত বিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে।

আম্বেদকর যে কেবল হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত জাতপাতের সমালোচনা করেছিলেন তাই নয়, একইসঙ্গে মুসলমান ধর্মের গোঁড়ামি ও তাদের ভাতৃত্ববোধের নাম করে ব্যক্তি স্বাধীনতা বিরোধী আচরণের তীব্র নিন্দা করেছিলেন তিনি। একজন মুসলমান পুরুষের একাধিক বিবাহের তীব্র বিরোধী ছিলেন বাবাসাহেব। খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে বোঝা যায় তিনি ছিলেন যেকোনো মৌলবাদী কার্যকলাপ বিরোধী মানুষ।

images 21 1
India Today

সেই আম্বেদকরকে যখন স্বাধীন ভারতের প্রথম আইন মন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন জহরলাল নেহেরু, তিনি তখন সেই প্রস্তাব উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেন। নেহেরু বুঝেছিলেন আম্বেদকরই হচ্ছে সেই উপযুক্ত ব্যক্তি যার হাতে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা দায়িত্বভার দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে তিনি উন্নত বিশ্বের একাধিক দেশের সংবিধানকে নমুনা হিসাবে বিবেচিত করলেও ভারতীয় সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে তার মূল শক্তি লুকিয়ে ছিল বৌদ্ধ ধর্মের বৈষম্যহীন জ্ঞান চর্চার মধ্যে। যদিও সংবিধান রচনা করার সময় আম্বেদকার সমস্ত জাতি ও ধর্মকে সমান নজরেই দেখেছিলেন।

তার শেষ জীবনে ডায়াবেটিস সহ নানান অসুখে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। চোখের দৃষ্টিশক্তিও প্রায় চলে গিয়েছিল। তার সত্বেও বরাবরের অভ্যাস মতো অতিরিক্ত চাপ নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। যা তার অসুস্থ শরীর নিতে পারেনি। তার ফলস্বরূপ ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে রাত্রিতে ঘুমের মধ্যেই দিল্লির বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভিমরাও বাবাসাহেব আম্বেদকার।

আম্বেদকারের মৃত্যু দিনেই ১৯৯২ সালে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটি বোধহয় ঘটে। ঐদিন একদল ধর্মান্ধ মানুষের তাণ্ডবে ভেঙে পড়ে বাবরি মসজিদ। আম্বেদকর যে সংবিধান রচনা করে গিয়েছিলেন তা সেই দিন‌ই ব্যর্থ হয়ে যায়।

আম্বেদকারের মৃত্যুর ফলে এক প্রগাড় জ্ঞ্যানী ব্যক্তির পরামর্শ ও সহযোগিতা থেকে চির দিনের জন্য বঞ্চিত হয় ভারতবাসী। তাদের এই শোক-তাপ কোথাও গিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। তবে আমাদের কাছে আজও ৬ ডিসেম্বর মানে কেবলমাত্র বাবরি মসজিদ ধ্বংস নয়, ৬ ডিসেম্বর মানে প্রগাঢ় জ্ঞানের ভান্ডার আম্বেদকরের চলে যাওয়ার দিন।