করোনার সংক্রমণ প্রথম শুরু হয়েছিল চীন থেকে। সেখানকার উহান প্রদেশ থেকেই এর সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করে। যদিও মাস চারেকের মধ্যেই নিজেদের পরিস্থিতি অনেকটাই সামলে নিতে পেরেছে চীন। এরই মধ্যে এই সংক্রমনের ঢেউ আছড়ে পড়ে ইউরোপ এবং আমেরিকায়। ইউরোপের ইতালি, স্পেনেরর মত দেশগুলোতে হাজারে হাজারে করোনা রুগী মারা যেতে শুরু করেন। সে এক ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছিল গোটা ইউরোপে। জারি হয়েছিল দীর্ঘ দিনের লকডাউন।

আমেরিকাতে সার্বিকভাবে লকডাউন জারি না করলেও অনেকগুলি প্রদেশ পৃথক পৃথকভাবে লকডাউন ঘোষণা করে। ২০২০ সালে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ হয়েছিল আমেরিকায়। ভারতেও রীতিমতো থাবা বসিয়েছিল করোনার প্রথম ঢেউ। তবে কঠোর লকডাউন বিধি প্রণয়ন করে এবং দ্রুত আক্রান্তদের চিহ্নিত করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রথম ঢেউকে কোন‌ওরকমে সামলে উঠতে পেরেছিল ভারত। কিন্তু ইতিমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মত ভারতেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে।

বর্তমানে সমস্ত দেশকে ছাড়িয়ে ঘরনার দ্বিতীয় ঢেউ সবচেয়ে প্রবল ভারতে। দৈনিক সংক্রমনের নিরিখেই হোক আর মোট সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা, সবক্ষেত্রেই রেকর্ড করছে ভারত। এমনকি এদেশে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সর্বকালের রেকর্ড তৈরি করেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল কমার বদলে দেশে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অক্সিজেন এবং হাসপাতালের শয্যার চাহিদা। হঠাৎ করে এই সংক্রান্ত পরিকাঠামো বৃদ্ধি করাটা যেমন সমস্যার, তেমনই ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। সেই কারণে দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই আরও কঠিন। যার ফল ভোগ করে প্রতিদিন প্রায় চার হাজারের কাছাকাছি মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন করোনায়।

এত খারাপের মধ্যেও একটু হলেও আশার আলো আছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন করোনা সংক্রমণ আস্তে আস্তে কমে যেতে বাধ্য। তবে তার জন্য তারা বেশকিছু প্রক্রিয়াও মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা আজকে আলোচনা করব করোনা সংক্রমণ কবে কিভাবে কমে যেতে পারে।

১) দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন-

এই মুহূর্তে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউন চলছে। আবার পশ্চিমবঙ্গের মতো অনেক রাজ্যে লকডাউন না হলেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ জারি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতিটি রাজ্যের যথেষ্ট কড়াকড়ি জারি করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও করোনা সংক্রমণ ঠিকভাবে আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। তা ব্যাপকহারে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।

করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে বিশেষজ্ঞরা প্রথম ঢেউয়ের মতোই দেশব্যাপী কঠোর এবং সার্বিক লকডাউনেরর সুপারিশ করেছেন। তাদের মতে ভারতের পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। একমাত্র লকডাউন জারি করে এই হাল ফেরানো সম্ভব। কারণ লকডাউন জারি হলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাতে একজনের থেকে আরেকজনের কাছে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ক্রমশ কমতে থাকবে। তাই বিশেষজ্ঞদের হিসাবমতো কমপক্ষে তিন থেকে চার সপ্তাহের লকডাউন জারি করলে করোনা সংক্রমণের স্রোত ক্রমশ নিম্নমুখী হবে। তারপরও তারা কঠোর বিধি-নিষেধ জারি রাখার সুপারিশ করেছেন আর‌ও একমাস। তাহলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ থেকে পরিষ্কার ভারতের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অন্ততপক্ষে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হয়ে যাবে।

২) সার্বিক টিকাকরণ-

করোনা টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে যতটা আশার আলো দেখিয়ে ভারত হাঁটা শুরু করেছিল তা বর্তমানে খুঁড়িয়ে চলায় পর্যবসিত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে দেশের বেশিরভাগ করোনা টিকা বিদেশে রপ্তানি করে দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোরালো। এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরিষ্কার বক্তব্য করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হল দেশের বেশিরভাগ মানুষকে টিকা প্রদান করা।

ভারত সরকার যদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে আগামী এক মাসের মধ্যে দেশের অন্ততপক্ষে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষকে করোনা টিকার দুটি ডোজ‌ই প্রদান করতে সক্ষম হয় তবে এই পরিস্থিতির উন্নতি গঠতে বাধ্য। সেক্ষেত্রেও হিসেব বলছে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে গিয়ে দেশে করোনা সংক্রমণকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

৩) স্বাভাবিক গতিতে সংক্রমনের অবনমন-

ল্যানসেটের মত বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকাতে বলা হয়েছে ভারতে করোনার যে দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে তা শিখর ছোঁবে মে মাসের মাঝামাঝি সময় করে। অর্থাৎ এরপর থেকে এদেশের করোনা সংক্রমনের গ্রাফ ক্রমশ নিম্নমুখী হবে। বিজ্ঞানের এই স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী মে মাসের শেষের দিকে হয়তো দেশের করোনা পরিস্থিতি বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক নিয়মের ওপর ভরসা করলেই হবে না, এর সঙ্গে সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসনকে যথেষ্ট সচেষ্ট হতে হবে। তবেই সাফল্য মিলবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।

৪) যাবতীয় উৎসব অনুষ্ঠান এবং জমায়েত বন্ধ রাখা-

শত খারাপের মধ্যেও মানুষ একটু ভালো থাকার জন্য উৎসব-অনুষ্ঠানে সামিল হয়। কিন্তু এই করোনা পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আগামী অন্ততপক্ষে এক বছর কোন‌ও কিছু উপলক্ষ্যেই জমায়েত করা চলবে না। অর্থাৎ দেশের করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য এক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। বর্তমানে প্রতিটি রাজ্যে জামায়াত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা সাময়িক হলে চলবে না, অন্তত আগামী এক বছর কঠোরভাবে যে কোনও অনুষ্ঠান ও জামায়াতের ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা জরুরি। এই ঘটনা ঘটলে তবেই সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকানো সম্ভব।

৫) চিকিৎসা পরিকাঠামোর উন্নতি-

অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন করোনা ভাইরাসকে ঠেকানো গেলেও তা একেবারে বিশ্ব থেকে নির্মূল করে দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ করোনা মনুষ্যসমাজে থেকে যাবে। সেই জন্যই সরকারের উচিত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বিপুল উন্নতি ঘটানো, যাতে বর্তমান সময়ের মতো আবারও কখনও হঠাৎ করে করোনা সংক্রমনের গতি ঊর্ধ্বমুখী হলেই তৎক্ষণাৎ উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকাঠামোর সাহায্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।

করোনা মোকাবিলায় উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকাঠামো থাকলে ভারতের পরিস্থিতি এতটা কঠিন হত না। এই বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দেশ বর্তমানে ঠিক কতটা পিছিয়ে আছে। এ থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ যত দ্রুত সম্ভব এই ভুল সামলে নেওয়া। তাহলে আগামী দিনে অন্তত এই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি আর হতে হবে না।