২০০৮ এর ২৬ নভেম্বর রাতেই টিভির মাধ্যমে গোটা দেশবাসী জেনে যায় মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে। বিভিন্ন ফুটেজে দেখা যাচ্ছে সাত-আটজন তরুণ যুবক হাতে বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বা হঠাৎ করে কোনো এক দিকে তাক করে গুলি চালিয়ে দিচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এগুলো বেশ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। আমরা সাধারন মানুষেরা খুব স্বাভাবিকভাবেই বিস্তারিত চিনিনা, তাই নিজেদের মতো করে অনুমান করে নিচ্ছিলাম ওগুলো একে-৪৭, একে-৫৬ কেউবা ভাবছিলাম স্টেনগান বা লাইট মেশিনগানও হতে পারে।

সাধারণ মানুষদেরকে খোলামকুচির মতো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে শিউরে উঠে ছিলেন অনেকেই। সহ্য করতে না পেরে টিভিটা বন্ধ করেও দিয়েছিল কেউ কেউ। কিন্তু যারা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দেশের সেই নিরাপত্তা বাহিনী এবং প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তিরা এর ব্যাপকতা প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলেন। তারা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন ভয়ঙ্কর বিপদ ঘনিয়ে উঠেছে দেশের বাণিজ্য নগরীতে। তবে তার ভয়াবহতা যে এত দূর বিস্তৃত হবে তা নিশ্চয়ই তখনই বুঝে উঠতে পারেননি। তারা শুধু এটুকু বুঝে উঠতে পেরেছিলেন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, না হলে রক্তগঙ্গা নয় লাল রংয়ের সমুদ্র রচনা হবে মুম্বাইয়ের বুকে!

images 44 2
Hindustan Times

আর এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করেই দ্বিধাহীনভাবে মুহূর্তের মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন হেমন্ত কারকারে। পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে বসে সেটাও সম্পূর্ণ করার সুযোগ পাননি মুম্বাই পুলিশের anti-terrorist squad (ATS) এর এই প্রধান। শহর জোড়া সন্ত্রাসবাদি হামলা হয়েছে এই খবর পেয়েই আর কোনো কিছুর ভাবনা চিন্তা না করেই গাড়ির চালক এবং ব্যক্তিগত দেহরক্ষীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে অবশ্যই বুলেট প্রুফ জ্যাকেট এবং হেলমেট নিয়েছিলেন। এটা সেই বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, যেটা নিয়ে পরে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল।

তিনি প্রথমেই গিয়ে পৌঁছন মুম্বাইয়ের শিবাজী টার্মিনাস রেলস্টেশনে। যদিও ততক্ষনে সেখানে সব শেষ হয়ে গিয়েছে, নেমে এসেছে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। ওই ধ্বংসলীলা দেখে কি মুহূর্তের জন্য মনটা কেঁপে উঠেছিল এই দাপুটে আইপিএস অফিসারের ? না বোধহয়। তার দীর্ঘ ট্র্যাক রেকর্ড জানান দেয় ইস্পাত কঠিন মানসিকতার অধিকারী মুম্বাই পুলিশের এই অফিসারটি সদাসর্বদা দায়িত্ব পালনে অবিচল। সেই দায়িত্ব পালনের পথ থেকে কোনো কিছুই তাকে নড়াতে সক্ষম হয় না। আর তাইতো মুহূর্তের মধ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে ছুটে যান কামা হাসপাতালের দিকে। ততক্ষণে তার কাছে খবর চলে এসেছে সন্ত্রাসবাদীরা ওই হাসপাতালে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

220px 2008 Mumbai terror attacks Karkares death location
Wikipedia

কামা হাসপাতালে যাওয়ার পথে তার সঙ্গে যোগ দেন মুম্বাই পুলিশের অপর দুই অভিজ্ঞ অফিসার অশোক কামতে এবং বিজয় সালাস্কার। তারা সঙ্গে থাকা হাতিয়ার নিয়েই ফিঁদায়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই জঙ্গিদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে এবং বড় বাহিনী নিয়ে আসার সময়টুকু পর্যন্ত পাননি তারা। কামা হাসপাতলে পৌঁছে দেখেন যুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে অ্যাডভান্টেজ অবস্খাতে আছে আজমাল কাসাব এবং ইসমাইল খান। এই দুই লস্কর-ই-তৈবা জঙ্গির গুলি এবং ছোড়া গ্রেনেডের আঘাতে মৃত্যু হয় হেমন্ত কারকারের। তার‌ই সঙ্গে প্রাণ হারান অশোক কামতে এবং বিজয় সালাস্কার।

মুম্বাই পুলিশের বিভিন্ন মহল সূত্রে পরবর্তীতে জানা যায় মৃত্যুর আগের মুহূর্তে আহত অবস্থাতেই গুলি চালিয়ে আজমল কাসাবকে আহত করতে সক্ষম হন হেমন্ত। তার ফলেই নাকি এই তরুণ জঙ্গির হাত গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে। যার ফলস্বরূপ কাসাব আগ্নেয়াস্ত্র তুলতে সক্ষম ছিল না। নিয়তির পরিহাস আজমল কাসাবকেই একমাত্র জীবিত জঙ্গী হিসাবে আটক করতে সক্ষম হয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী।

images 45 2



পরবর্তীকালে হেমন্ত কারকারের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তার পরিবার এবং মুম্বাই পুলিশের একাংশের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয় নিম্নমানের জ্যাকেট হওয়ায় তা ভেদ করে গুলি কারকারের বুকে গিয়ে বিঁধেতে সক্ষম হয়েছিল। আবার অনেকে এই দক্ষ পুলিশ অফিসারের মৃত্যুর ঘটনায় রহস্য আছে বলেও মনে করেন।

মুম্বাইয়ের বুকে ২৬/১১ এর জঙ্গি হামলা হেমন্ত কারকারের মতো দক্ষ ও সৎ পুলিশ আধিকারিকের জীবনের শেষ দিন রচনা করেছিল। তার ফলে দেশজোড়া শহীদের সম্মান পান তিনি। তার এই আত্ম বলিদান দেশবাসীর মনের মনিকোঠায় আজও জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু হেমন্ত কারকারে হয়ে ওঠাটা এতো সহজ ছিল না। তিনি এন‌আইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে হিন্দুস্তান লিভার কাজ করেছে। কিন্তু তার বরাবরের ইচ্ছা ছিল পুলিশ হিসাবে অপরাধীদের দমন করে মানুষকে সাহায্য করা। তাই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসেন এবং সফল হয়ে ১৯৮২ সালে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন।

চাকরিতে যোগদান করার প্রথম দিন থেকেই তার কর্ম দক্ষতা এবং সত্যের প্রতি অবিচল মনোভাব উচ্চপদস্থ অফিসারদের নজর কেড়ে নিয়েছিল। তার দক্ষতা দেখে র’এর আধিকারিকরা তাকে বিশেষ দায়িত্ব দেন। দীর্ঘ সাত বছর অস্ট্রিয়ায় র’এর দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছিলেন। পরবর্তীতে মুম্বাই পুলিশে ফিরে আসার পর অন্যতম যুগ্ম কমিশনার পদ লাভ করেন। তাকে মুম্বাই এটিএসের প্রধান হিসাবে দায়িত্বভার দেওয়া হলে তিনি বাহিনীকে আরও দক্ষ ভাবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন।

images 46 1
Awaaz Nation

এটিএস প্রধান হিসাবে মুম্বাইয়ের মালেগাঁও বিস্ফোরণকাণ্ডের তদন্ত করছিলেন এই দক্ষ পুলিশ অফিসার। সেই সূত্রেই তিনি বিতর্কিত বিজেপি নেত্রী সাধ্বী প্রজ্ঞাকে গ্রেপ্তার করেন। হিন্দু সন্ত্রাসবাদের স্বরূপ তিনিই প্রথম সবার সামনে উন্মোচন করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি, সংঘ পরিবার সহ হিন্দুত্ববাদী দল ও সংগঠনগুলি তার বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তথা তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই নির্ভীক পুলিশ অফিসারকে “দেশদ্রোহী” বলেছিলেন !

যদিও কোনো সমালোচনা এবং বিরোধিতাই তাকে তার অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে এই সাধ্বী প্রজ্ঞাই মধ্যপ্রদেশের ভূপাল লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করেছেন। লোকসভা নির্বাচনের প্রচার পর্ব চলাকালীন এই হিন্দুত্ববাদী নেত্রী দাবি করেছিলেন তার অভিশাপেই মৃত্যু হয়েছিল হেমান্ত কারকারের! তার সেই মন্তব্য ভালোভাবে নেয়নি দেশের সাধারণ মানুষ। তারা বিজেপির কাছে আবেদন জানিয়েছিল সাধ্বী প্রজ্ঞার প্রার্থী পদ খারিজ করার জন্য। যদিও তা করা হয়নি।

আসলে তা করা হয় না। এই দেশে হেমন্ত কারকারে, বিজয় সালাস্কারের মতো দক্ষ পুলিশ অফিসাররা মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হয়ে যান। তা সত্বেও তাদের কোনো দাম থাকেনা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। এদের কাছে দাম থাকে সাধ্বী প্রজ্ঞার মতো মানুষদের, যারা নিজেদের স্বার্থে দেশের মানুষকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পর্যন্ত বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না।

images 47 2
Wikimedia Commons

২০০৯ সালে হেমন্ত কারকারেকে মরণোত্তর অশোক চক্র প্রদান করা হয় তার কৃতিত্বের ও আত্ম বলিদানের স্বীকৃতি স্বরূপ।

নিজের ও পরিবারে স্ত্রী-মেয়েদের কথা না ভেবে দেশ ও মানুষের প্রতি কর্তব্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবিচল থাকা এই পুলিশ অফিসারের আজ জন্মদিন (জন্ম: ১২ ডিসেম্বর, ১৯৫৪) । আসলে হেমন্ত কারকারেরা শেষ হয়ে যান না। তাদের স্মৃতি তাদের কাজ অনুপ্রেরণা হিসাবে কোটি কোটি দেশবাসীর বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকে যা আগামী দিনে আরো অনেক হেমন্ত কারকারে, অশোক কামাতে, বিজয় সরকারের জন্ম দেয়!