এই মুহূর্তে কৃষক আন্দোলন নিয়ে পুরো দেশ উত্তাল। কৃষক সংগঠন গুলো কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি নতুন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড়। অপরপক্ষে কেন্দ্রীয় সরকার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে তারা এই আইন গুলিতে কিছু পরিবর্তন করতে রাজি আছে, কিন্তু সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে কোনো মতেই সম্মত নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে কৃষকরা “কসমেটিক্স চেঞ্জ”  বলে চিহ্নিত করেছে। তারা আইন প্রত্যাহার করা ছাড়া আর অন্য কোনো দাবি মেনে নিতে রাজি নয়।

কৃষকদের অন্যতম উদ্বেগের জায়গা হলো এমএসপি অর্থাত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য  উঠে যেতে পারে নতুন কৃষি আইন বলবৎ হলে। কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে ৫ রাউন্ড আলোচনার পর কেন্দ্রীয় সরকার আপাতত এমএসপি আগের মতই বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জন্য তারা লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতেও প্রস্তুত। যদিও কৃষকরা শুধুমাত্র এইটুকু দাবি পূরণে সন্তুষ্ট নয়, তারা তাদের বিল প্রত্যাহার সংক্রান্ত পুরানো দাবিতেই অনড়।

কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ), জয়ললিতার এআইএডিএমকে এবং জগন্মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস ছাড়া দেশের বাকি সমস্ত বিরোধী দল সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তারা এই কৃষি আইনকে সংবিধান বিরোধী এবং রাজ্যগুলির স্বার্থের পরিপন্থী বলে দাবি করছে। আমরা বরং বিতর্কিত কৃষি আইন তিনটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিই-

১) ফারমার্স প্রডিউস ট্রেড এন্ড কমার্স (প্রমোশন এন্ড ফেসিলিটেশন) বিল ২০২০

এই বিলটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো-

• চুক্তিভিত্তিক চাষ আইনসম্মত করা হবে।
• পচনশীল ফসলের জন্য পৃথক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
• কৃষকরা চাইলে কৃষি মান্ডির বাইরেও উৎপন্ন ফসল বিক্রি করতে পারবে। এক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা থাকবে না।
• উৎপাদিত কৃষিপণ্যের আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো বাধা-নিষেধ থাকবেনা। বেসরকারি সংস্থাগুলি এক রাজ্যের কৃষকদের থেকে ফসল কিনে অন্য রাজ্যে নিয়ে গিয়ে তা বিক্রি করতে পারবে।

২) ফারমার্স (এম্পাওয়ার্মেন্ট এন্ড প্রটেকশন) এগ্রিমেন্ট অফ প্রাইস অ্যাসিওরেন্স এন্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল, ২০২০

এই বিলটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো-

• চুক্তি চাষ সম্বন্ধে বিস্তারিত এই বিলে বলা হয়েছে। কৃষকরা ফসল উৎপাদনের আগেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তির সঙ্গে ফসলের পরিমাণ ও গুণমান নিয়ে আগাম চুক্তি করতে পারবে।
• কৃষকদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে উৎপাদিত ফসল কোথায় কিভাবে বিক্রি করবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে।

৩) এসেনশিয়াল কমোডিটিস (আমেন্ডমেন্ট) বিল, ২০২০

এই বিলটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো-

• চাল ডাল ভোজ্য তেল আলু পিঁয়াজের মতো কৃষিজ দ্রব্যগুলি আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসাবে বিবেচিত হবে না।
• ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো পরিমাণ দ্রব্য মজুদ করতে পারবে।
• মজুতদারী নিয়ন্ত্রণে রাজ্যগুলির আর কোনো ভূমিকা থাকবে না।
• দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘটার মতো অতি জরুরী ক্ষেত্র ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার ফসলের মজুতদারী নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করবে না।

এই তিনটি কৃষি আইনকে নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বলে চিহ্নিত করেছেন। তার দাবি ১৯৯১ সালে দেশের শিল্পক্ষেত্রে সংস্কার ঘটে। সরকার আইন প্রণয়ন করে শিল্প সংস্থা পরিচালনায় বেসরকারি ক্ষেত্রকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়। কিন্তু ওই সময় কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই প্রথম ভারত সরকার কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার সাধনে উদ্যোগ গ্রহণ করল বলে দাবি করেন তিনি।

কৃষি আইনকে সমর্থন করেন এরকম অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো-

১. দেশি ও বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রকে আকর্ষনীয় করে তুলতে গেলে এই তিনটি নতুন আইন তৈরি করা খুব জরুরি ছিল।

২. নতুন কৃষি আইনের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা হ্রাস পাওয়ায় বেসরকারি সংস্থাগুলির মুনাফা করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই তারা এই ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ দেখাবে।

৩. চুক্তি চাষ আইন সম্মত হওয়ায় কৃষকদের ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে।

৪. বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা কৃষি পণ্যের ব্যবসায় প্রবেশ করলে স্বাভাবিকভাবেই আরও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য পাবে কৃষকরা। যার ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্র আধুনিক হয়ে উঠবে।

৫. মজুদদারির অধিকার থাকার ফলে কৃষি পণ্যের ব্যবসা বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার নতুন কৃষি আইনকে কৃষক স্বার্থে অগ্রগতির পথে পদক্ষেপ বলে চিহ্নিত করেছেন। তাদের দাবি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কৃষকদের ভুল বুঝিয়ে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের এই দাবি কৃষকরা ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণরূপে নস্যাৎ করে দিয়েছে। আমরা বরং দেখেনিই ঠিক কোন কোন যুক্তিতে কৃষকরা নতুন কৃষি আইনগুলির বিরোধিতা করছে।

১) ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এম‌এসপি)

কৃষক সংগঠনগুলির দাবি নতুন কৃষি আইনে চুক্তি চাষ এবং কৃষি মান্ডির বাইরে উৎপন্ন ফসল কেনাবেচার বিষয়টি আইন সম্মত হওয়ায় সরকার নির্ধারিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অস্তিত্ব আর থাকবে না। এর ফলে কৃষকরা বেশিরভাগ সময়ই ফসলের ন্যায্য দাম পাবে না।

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে দাবি করা হয়েছিল এমএসপি ব্যবস্থায় কৃষকদের যা আয় হয় নতুন কৃষি আইনের ফলে তার চেয়ে বহু গুণ বেশি আয় হওয়া সম্ভব। পরবর্তী পর্যায়ে কৃষক আন্দোলনের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার এমএসপি ব্যবস্থা বজায় রাখার দাবি মেনে নিতে সম্মত হয়েছে। তারা জানিয়েছে কৃষকরা চাইলে এমএসপি ব্যবস্থার সাহায্য নিতে পারবে।

আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় কৃষকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে শুধু এমএসপি ব্যবস্থা চালু রেখে কৃষকদের বিশেষ কোনো লাভ হবে না। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছে সরকার হয়তো ধীরে ধীরে কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কেনা কমিয়ে দেবে। সেই সঙ্গে তাদের দাবি দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা অসহায় হয়ে পড়বে যদি এমএসপি ব্যবস্থা বজায় না থাকে। বিহারের উদাহরণ দিয়ে কৃষক সংগঠনগুলি দাবি করেছে এমএসপি ব্যবস্থা চালু না থাকলে কৃষকরা ফসল উৎপাদনের খরচ টুকুও ফসল বিক্রি করে জোগাড় করতে পারবে না।

২) চুক্তি চাষ

দেশে চুক্তি চাষ ব্যবস্থা চালু করার ঘোর বিরোধী কৃষক সংগঠনগুলি। তাদের বক্তব্য এই ব্যবস্থা চালু হলে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির কাছে কৃষকেরা দাসে পরিণত হবে। কোনো কৃষক যদি একবার কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে ফেলে তবে তারা আর বেরোনোর পথ থাকবে না। কৃষকদের দাবি কর্পোরেট সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তিকারী কোনো কৃষক ওই কর্পোরেট সংস্থার পছন্দমত ফসল উৎপাদন করতে বাধ্য থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কৃষক সংগঠনগুলির প্রশ্ন কোনো কারণে উৎপাদিত ফসলের গুণমান যদি চুক্তি মত না হয় সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কৃষক কী করবে ?

কৃষকদের যুক্তি খন্ডন করে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি কেবলমাত্র উৎপাদিত ফসল নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবে। কৃষকদের জমি সংক্রান্ত কোনো চুক্তি করার অধিকার সংস্থাগুলির থাকবে না।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই যুক্তি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে কৃষকরা। তাদের বক্তব্য চুক্তি চাষ চালু হলে প্রথম পর্যায়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলি কৃষকদের ফসলের বেশি বেশি দাম দেবে। একবার যখন বেশিরভাগ কৃষক এই ব্যবস্থার অধীন চলে আসবে তখন দেশে এমএসপি ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। এরপর‌ই কর্পোরেট সংস্থাগুলি আসল রূপ ধারণ করবে। কৃষকরা তখন বিকল্প উপায় না পেয়ে স্বল্প অর্থের বিনিময় চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য হবে সংস্থা গুলির সঙ্গে। এর ফলে দেশের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ঋণভারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের জমি বিক্রি অথবা বন্ধক দিতে বাধ্য হতে পারে বলে মনে করছে কৃষক সংগঠনগুলি।

কৃষক সংগঠনগুলির দাবি দেশের বেশির ভাগ কৃষক আইন-কানুন সম্বন্ধে সেভাবে সচেতন নয়। তাই বেসরকারি সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময় তাদের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট পরিমাণে আছে। বিশেষত দেশের ৮৬ শতাংশ কৃষকের জমির পরিমাণ ২ একরের কম হওয়ায় কর্পোরেট সংস্থাগুলি সরাসরি এই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবে বলে তারা মনে করছে না। তাদের ধারণা মধ্যস্বত্বভোগীরা একসঙ্গে অনেক কৃষককে জড়ো করে কর্পোরেট সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি করবে। কৃষি বিলের বিরোধী অর্থনীতিবিদদের মতে চুক্তি চাষ চালু হলে দেশে “দাদন প্রথা”  ফিরে আসবে। এর ফলে দেশের কৃষি ব্যবস্থা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ফিরে যাবে বলে মনে করছে কৃষকরা।

৩) মান্ডি প্রথার বিলোপ

২০০৩ সালে আইন করে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি রাজ্যকে কৃষকদের ফসল কেনার জন্য মান্ডি ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছিল। সেই মোতাবেক দেশের সর্বত্র কৃষি মান্ডি গড়ে ওঠে। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৬ হাজার ৪০০ টির বেশি কৃষি মান্ডি আছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল এই কৃষি মান্ডিগুলোতে এনে সরকার নির্ধারিত নূন্যতম সহায়ক মূল্যে বিক্রি করে থাকে। কৃষক সংগঠনগুলির অভিযোগ চুক্তি চাষ প্রথা বলবৎ হলে স্বাভাবিকভাবেই কৃষি মান্ডিগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে সরকার যতই এমএসপি বজায় রাখার কথা বলুক না কেন, তা কার্যকরী হওয়া সম্ভব হবে না।

কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে চুক্তি চাষ ব্যবস্থা চালু হলেও কৃষি মান্ডিগুলি আগের মতোই সক্রিয় থাকবে।

সরকারের এই আশ্বাস বাণীতে কৃষক নেতারা ভুলতে রাজি নন। তারা বলছেন সরকার এখন চাপে পড়ে কৃষি মান্ডিগুলি চালু রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও স্বাভাবিক নিয়মে সেগুলি বন্ধ হয়ে যাবে। আর তার ফলে দেশের অসংখ্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিপন্ন হয়ে পড়বে।

৪) অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন

নতুন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের ফলে চাল ডাল ভোজ্য তেল আলু পিঁয়াজের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিস গুলি মজুতদারি করার অধিকার পেয়ে গিয়েছে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি। কৃষক নেতাদের মতে এর ফলে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি কৃষকদের কাছ থেকে স্বল্প দামে ফসল কিনে তা চড়া দামে বিক্রি করে অত্যধিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ পেয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে মজুদদারির অধিকার থাকার ফলে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি দেশেতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি করবে। তার ফলে সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের খরচ অনেক বৃদ্ধি পাবে।

নতুন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের পক্ষে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিকে মুনাফা করার সুযোগ করে না দিলে তারা কৃষিক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাবে না। সেইসঙ্গে কেন্দ্রের দাবি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি মুনাফা করার সুযোগ পেয়ে কোল্ড স্টোরেজ, পণ্য পরিবহনের মতো ক্ষেত্রগুলিতে পরিকাঠামো গড়ে তুলতে অর্থ বিনিয়োগ করবে। যার সুযোগ নিয়ে দেশের কৃষি ব্যবস্থার আরো উন্নতি ঘটবে।

কৃষক সংগঠনগুলির দাবি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে কেবলমাত্র দেশের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তাদের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতিটা সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তারা এক্ষেত্রে আলুর সাম্প্রতিক দাম বৃদ্ধিকে উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করেছে। তাদের বক্তব্য নতুন আইন অনুযায়ী রাজ্য সরকারগুলির মজুদদারি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আর কোনো ভূমিকা থাকবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের‌ও যুদ্ধের পরিস্থিতি ছাড়া মজুদদারী নিয়ন্ত্রণ এবং দাম নিয়ন্ত্রণের অধিকার না থাকায় দেশের কৃষিপণ্য কেনা-বেচার বাজার সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি সংস্থা গুলির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। সেইসঙ্গে এক রাজ্যের উৎপাদিত ফসল অন্য রাজ্যে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করার অধিকার থাকায় দেশের মধ্যে ফসল বিতরণের ক্ষেত্রে ভারসাম্যের অভাবে ঘটতে পারে বলে তাদের দাবি।

বিজেপি বিরোধী দলগুলি ক্ষমতায় থাকা রাজ্যের সরকার এবং দেশের প্রায় প্রতিটা বিরোধী দল কৃষি বিলের বিরুদ্ধে তাদের আপত্তি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। রাজ্য সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কী কী কারনে এই কৃষি বিল তিনটির বিরোধিতা করছে তা একবার আমরা দেখে নিই-

১) যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোয় হস্তক্ষেপ

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি সংবিধানে কৃষি কেন্দ্র ও রাজ্য যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়। কিন্তু নতুন কৃষি আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে বঞ্চিত করে কৃষি ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। যা সম্পূর্ণভাবে সংবিধান বিরোধী। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই পদক্ষেপকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ওপর কুঠারাঘাত বলে মনে করছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে কৃষি কেন্দ্র ও রাজ্য যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয় হওয়ায় তাদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে এই ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করার এবং তা রাজ্য সরকার গুলি মানতে বাধ্য।

২) রাজ্যগুলির রাজস্ব ক্ষতি

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নিয়ন্ত্রণে থাকা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে কৃষি মান্ডিতে কৃষকদের উৎপন্ন ফসল কেনাবেচার ওপর কর চাপিয়ে রাজ্যগুলির বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হতো। নতুন কৃষি আইনের ফলে মান্ডিগুলির গুরুত্ব চলে যাবে। তারফলে রাজ্য সরকারগুলির বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হাতছাড়া হবে।

৩) দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া বৃদ্ধি পেলেও কিছু করার থাকবে না

রাজ্য সরকার গুলির অভিযোগ নতুন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুত করলেও তা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাজ্যগুলির হাত থেকে চলে যাওয়ার ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও তারা রাজ্যের মানুষকে সুরাহা দিতে পারবেনা। এর ফলে রাজ্যবাসীর দুর্দশা চরম সীমায় পৌঁছতে পারে।

৪) চুক্তি চাষের ফলে আইন-শৃংখলার সমস্যা

চুক্তি চাষের ফলে কৃষকদের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে গেছে বলে মনে করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। এর ফলে প্রতারিত কৃষকরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে রাজ্যে আইন-শৃংখলার ব্যাপক সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে রাজ্য সরকারগুলি মনে করছে।

কৃষকদের দাবি এবং কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কার করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগকে মাথায় রেখেই একটা কথা আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে অন্য অনেক জিনিস না পেলেও আমরা বেঁচে থাকতে পারি, কিন্তু স্বাভাবিক জৈবিক কারণে আমাদের প্রত্যেককে বেঁচে থাকতে গেলে খাবার খেতেই হবে। আর সেই খাবারের একমাত্র যোগানদার হলো কৃষকরা। তাই কৃষকরা তাদের দায়িত্ব অর্থাৎ কৃষিকাজ করার ক্ষেত্রে যাতে নিরাপদ এবং স্বস্তি অনুভব করে সেদিকে সবারই লক্ষ্য রাখা জরুরি।

কৃষি আইনকে কেন্দ্র করে দেশ জোড়া বর্তমান যে পরিস্থিতি চলছে সে ক্ষেত্রে আইনের সুফল-কুফলের উর্ধে উঠে একটা কথা পরিষ্কার করে বলা যায়- যাদের জন্য আইন সেই কৃষকরাই যদি রাজি না থাকে তবে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এই তিনটি নতুন কৃষি বিল প্রত্যাহার করা।