অবশেষে চুড়ান্ত জল্পনা কল্পার অবসান ঘটিয়ে 2020 সালের মত বাতিল করা হল শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা; বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের আদেশানুসারে হতে পারে পৌষ উৎসবের আয়োজন
করোনাকালীন পরিস্থিতির জন্য অবশেষে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বাতিল করল শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী আনন্দোৎসব পৌষমেলা । কিছুদিন আগে অদ্বিও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায়রেখে পৌষমেলা হবে বলে স্থির ছিল । কিন্তু দূর্গোৎসবের পর অতিমারি পরিস্থিতির কথা মাথায়রেখে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তাদের মত পরিবর্তন করেন । বিগতদিনে ব্যবসায়ী সমিতির পৌষমেলা এবং মেলার মাঠে পাচিল তোলা নিয়ে অশান্তির সূত্রপাত ঘটে বিশ্বভারতীর সাথে, সেই অশান্তির রেষ কাটতে না কাটতেই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের এই নূতন সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ী সমিতির কাছে কতটা গ্রহনযোগ্য হবে সেটা সময়ই ঠিক করবে ।
গত সোমবার বিশ্বভারতীর কোর্ট সদস্যেরা ভ্যারচুয়াল বৈঠকের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এবছরের মত বন্ধ রাখা হবে পৌষমেলা, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে আয়োজিত হবে পৌষ উৎসব । এই কোর্ট সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, সাংসদ সুদীপ বন্ধ্যোপাধ্যায় ও স্বপন দাশগুপ্ত এবং প্রাক্তন বিচারপতি শখারাম সিং যাদব প্রমূখ । বিশ্বভারতী কোর্টের ৯০ জন সদস্যদের মধ্যে এই বৈঠকে হাজির ছিলেন ৭০ জন সদস্য, পৌষমেলা নিয়ে আলোচনার সময় মেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের দিকেই সায় দেন বেশিরভাগ সদস্য। পৌষ উৎসবের অনুষ্ঠানে সাধারন মানুষের প্রবেশাধিকার থাকবে কতটা সেই নিয়ে এখনও বিশ্বভারতীর তরফ থেকে সঠিককিছু জানা যায়নি ।
প্রত্যেক বছরই পৌষমেলার সাথে সাথে বিশ্বভারতী প্রাঙ্গন, ছাতিমতলা এবং উপাসনা গৃহে পালিত হয়ে আসছে পৌষ উৎসব । ঐতিহ্যময় এই পৌষ উৎসব আলাদা ভাবেই ইতিহাসে পাতায় স্বাক্ষর রাখে । ৭ ই পৌষ সকালে প্রাতঃ বৈতালিকের সাথে পৌষ উৎসবের সূচনা হয় । এই দিনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন, ইতিহাসের পাতায় দিনটি ব্রহ্ম ধর্মের সূচনা দিবস হিসেবে চিহ্নিত । সেই সময় এই বিশেষ ধর্মটির নাম ছিল ‘ বেদান্ত প্রতিপাদিত ‘ ধর্ম, এই ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার প্রায় ২ বছর পর ১৮৪৫ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রথম পৌষমেলা র সূচনা হয়, তবে শান্তিনিকেতনে নয়, প্রথম পৌষমেলা আয়োজিত হয় গেরিটির বাগান বাড়ীতে ।
এরপর ১৮৮৮ তে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার একটি অছিপত্রে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা শুরুর ইচ্ছে প্রকাশ করেন । মহর্ষির ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে অবশেষে ১৮৯৪ সালে শান্তিনিকেতনে শুরু হয় পৌষমেলা । মহর্ষি নিজে কখনও এই মেলায় যোগ দেননি, তবে মহর্ষি পুত্র রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ হাতে দায়িত্ব সহযোগে এই মেলার আয়োজন করেন । এখন যেই মেলার মাঠ নিয়ে সবত্র এত আলোচনা, এত উত্তেজনা, সেই মাঠে পৌষমেলা শুরু হয় অনেক পরে । রবিন্দ্রনাথের সময় মেলা বোসতো কাচ মন্দির বা উপাসনা গৃহ লাগোয়া মাঠ ‘জগদীশ কানন’ এ । বর্তমানে মাঠটি ‘পুরনো মেলার মাঠ’ নামে পরিচিত ।
এই ৭ ই পৌষ দিনটি শুধুমাত্র পৌষমেলা বা পৌষ উৎসবের জন্যই চিরস্বরনীয় নয়, আশ্রমিকদের কাছে এই দিনটির আরেকটি গুরত্ব হল, এই দিনই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’ বা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় । এছারও ১৯১০ সালে পৌষ উৎসবে আরেকটি ব্যাপ্তি ঘটান কবিগুরু , সে বছর ২৫ শে ডিসেম্বর কাচ মন্দিরে শান্তিনিকেতনের নিজস্ব ধারায় আয়োজিত হয় ‘খ্রিস্টোৎসব’ । আজও এই উৎসব ২৫ শে ডিসেম্বর সন্ধেবেলা কাচ মন্দিরে পালিত হয় । পৌষমেলা সম্পর্কীয় আরো বিস্তারিত তথ্য মেলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ এবং মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লেখা পৌষমেলা র ওপর প্রবন্ধ ইত্যাদি এবং আরো বই সমূহ থেকে ।
এই পৌষমেলা আয়োজনের পেছনে মূল কারনছিল গ্রাম বাংলার কুটির শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া । রবিন্দ্রনাথ ১৯০১ এ ‘তত্ত্ববোধিনী’ তে পৌষমেলা নিয়ে লিখেছেন, ‘খুব জনতা । বেশ ক্রয়-বিক্রয় চলিতেছে । বাউল সম্প্রদায় স্থানে স্থানে নৃত্যগীতি করিতেছে । চারিদিকে যেন আনন্দের জোয়ার’। সেই ‘আনন্দের জোয়ার’ এর রেষ কিছুমাত্র লঘু হয়নি বিগত ১০০ বছরেরও বেশী সময়ে । কিন্তু সেই ‘আনন্দের জোয়ার’ এ এবার বাধ সেধেছে করোনা ।
প্রথমদিকে পৌষমেলা হত একদিন, কিন্তু সময়ের সাথে মেলার পরিধি, ভৌগলিক স্থান এবং দিন সংখ্যাও পরিবর্তিত হয়েছে । বেরেছে মানুষের ঢল, পসাঢ় সাজিয়ে দেশ বিদেশের বহু দোকানিরা আজ পর্যন্ত জৌলুস বারিয়ে এসেছে পৌষমেলার , তবে এবারের মত সেই জৌলুসে আলো নিভোতে বাধ্য হল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ । দূর দূর থেকে আসা কুটির শিল্পীগন, বাউল, ছোটবড় ব্যাবসায়ীরা ইতিমধ্যেই আশাহত হয়েছেন । এছারাও হুচুকে বাঙালীর কাছে পৌষমেলা বাতিল হওয়ার খবরটি অনেকটাই অপ্রত্যাশিত । শান্তিনিকেতনের ব্যাবসায়ী সমিতির আর্থিকবস্থা বসন্ত উৎসব এবং পৌষমেলা দুটির ওপরে অনেকটাই নির্ভরশীল, সেখানে এবছর বসন্ত উৎসব না হওয়ায় পৌষমেলার উপরে অনেকটাই নির্ভর ছিলেন তারা । ইতিমধ্যে পৌষমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন সমগ্র শান্তিনিকেতনে শোকের মাহোল তৈরী হয়েছে ।
– ঈশিতা দাস
[…] […]
[…] ছোট মেয়ে মীরাদেবীর হাত ধরে শান্তিনিকেতনে আসেন রাধারাণী । রাধারাণী সামান্য […]