কবি লিখেছিলেন
“ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল….”,
সেই ধর্ম সম্পর্কে আজও অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। ধর্মের নামে হিংসা,বিভেদ,খুন,জখম,রাজনীতি এসব তো অহরহ চলতেই থাকে। তবে এই ধর্মের সীমাবদ্ধতারও উর্দ্ধে রয়েছে আর এক ধর্ম, মানবধর্ম বা মনুষ্যত্ব। এই ধর্মের সহনশীলতাও কখনও কখনও লঙ্ঘন হয়ে যায়। পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও অনেকে মনুষ্যত্বের ধার ধারেন না। কারণে অকারণে অন্য মানুষের দিকে বিদ্বেষ ছুঁড়ে দেওয়া এক শ্রেণীর মানুষের নেশা হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত এই নেশায় অপমানিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেক সাধারণ মানুষ এমনকি celebrity -দেরও কিছু ক্ষেত্রে এর সম্মুখীন হতে হয়। সেরকমই একটি উদাহরণ অভিনেত্রী শ্রুতি দাস। Zee bangla এ সম্প্রচারিত ধারাবাহিক ‘ত্রিনয়নী’-র মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র মেয়ে শ্রুতি দাস। বর্তমানে Star jalsha -র জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘দেশের মাটি’ -তে নোয়া-র ভূমিকায় অভিনয় করছেন অভিনেত্রী,সেখানেও বেশ সফল তিনি বরং ধারাবাহিকে অন্যান্য দের থেকে অনেকাংশে বেশি জনপ্রিয় তিনি। অভিনেত্রীর এই সফলতা মেনে নিতে পারছেন না নেটাগরিক দের একাংশ। ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন কখনও দেশের মাটির ফ্যান পেজে আবার কখনও অভিনেত্রীর সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলে। অভিনয়ে আসার আগে থেকেই অভিনেত্রী কে তার গায়ের রং নিয়ে বেশ কটাক্ষ-এর শিকার হতে হয়েছে। কখনও বন্ধুমহলে কখনও আত্মীয়স্বজন-র থেকে কখনও আবার নিজের প্রিয় জনদের থেকে এমনকি নিজের বিশেষ বন্ধুও কাঁচা হলুদ মাখার পরামর্শ দিয়েছে তাঁকে। এসবে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী নিজেও। সকলের চেনা মুখ হওয়ার সুবাদে এখন অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাচ্ছেন নেটাগরিকরা। অভিনেত্রীকে আক্রমণ করতে করতে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে cyber crime branch -এ অভিযোগ রুজু করতে বাধ্য হয়েছেন শ্রুতি দাস।
অভিনেত্রীর গায়ের রং কালো হওয়ার পরেও তিনি কিভাবে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছেন এই নিয়ে অনেকেরই অনেক আপত্তিকর মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে,তবুও মনের জোর হারাননি তিনি। মানুষের সহ্যের সীমা একটা সময়ের পরে অতিক্রান্ত হওয়া টাই স্বাভাবিক অভিনেত্রীর ও তাই হয়েছে। ‘পেত্নী’, ‘কুৎসিত’, ‘ওই ধারাবাহিক থেকে একে বাদ দেওয়া হোক’ এসবের সীমা ছাড়িয়ে এবার অভিনেত্রীর চরিত্র নিয়েও নোংরা কথা বলতে শুরু করে নেটাগরিকের একাংশ। “শরীর ভাঙিয়ে কাজের সুযোগ জোগাড় করে,ওকে কাছ থেকে দেখেছি” বলে দাবি করে সোশ্যাল মিডিয়ার একটি পোস্টে কমেন্ট করেন এক মহিলা। এই বক্তব্যের প্রত্ত্যুত্তরে আবার অভিনেত্রীর অনুরাগীরা বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ ও চেয়ে বসে। খোঁজ খবর নিয়ে অভিনেত্রী জানতে পারেন কটূক্তি করা মহিলা কাটোয়ার বাসিন্দা। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙার পরে অভিনেত্রী শ্রুতি দাস গত শনিবার ৮ জনের বিরুদ্ধে লালবাজার সাইবার সেলে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। শুক্রবার মহিলা কমিশনেও অভিযোগ করেন তিনি। পরবর্তীতে পুলিশ ও সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান “‘গায়ের রং কালো বলে ছোটবেলা থেকেই আমাকে নানা কথা শুনতে হয়েছে। আমি সবসময় অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলাম। আজ যে জায়গায় পৌঁছেছি, সেখানে পৌঁছনোর জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু এখনও আমার গায়ের রং কালো বলে হেনস্থা হতে হচ্ছে। অনেকে মনে করেন আমি ধারাবাহিকে চরিত্র পাওয়ার জন্য কম্প্রোমাইজ করি!”। বাংলা ধারাবাহিকের জনপ্রিয় লেখিকা লীনা গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে সমর্থন জানিয়েছেন শ্রুতিকে।
ই টাইমস টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “অনলাইনে কারওকে হেনস্থা করা আইনত অপরাধ। এই ধরনের কাজ মেনে নেওয়া যায় না”। উল্লেখ্য, লীনা গঙ্গোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের চেয়ার পার্সন। শনিবার অভিনেত্রীর বাড়িতে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে FIR রুজু করে লালবাজার পুলিশ। ২০২১ এ দাঁড়িয়ে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হওয়া শিক্ষিত সমাজের জন্য ঠিক কতটা লজ্জার তা বর্নণা করা হয়ত সম্ভব নয় তবে শ্রুতি দাসের পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসনীয়। এই বর্বরতার শিকার শুধুমাত্র অভিনেত্রী একা নন, সাধারণ মানুষের অনেককেই এইধরনের বক্তব্যের শিকার হতে হয় প্রতি মুহূর্তে। “মেয়েটা কালো কিন্তু মুখটা বেশ মিষ্টি” এটা খুব পরিচিত একটা কথা, কিন্তু এধরনের বক্তব্য যে কতটা অন্যায় তা বুঝিয়ে দেওয়ার সময় এবার হয়েছে। কালো মেয়েদের বিয়ে নিয়ে আজও অনেককেই অন্যরকম ভাবে ভাবতে হয়। আর কত যুগ চলবে এই অসভ্যতা তা আমাদের জানা নেই তবে অসভ্যতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সুযোগ বা অধিকার হয়ত সকলেরই কম বেশি আছে। প্রত্যেকে লজ্জাকে সরিয়ে one step এগিয়ে এলেই হয়ত রবিঠাকুরের কৃষ্ণকলিরা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হবে এই আশা করা যায়।