আমাজনের জঙ্গল বরাবরই রহস্য দিয়ে মোড়া। সেখানকার লক্ষ লক্ষ বছরের পুরোনো গাছেরা যেন সৃষ্টির আদি কাল থেকেই রয়ে গেছে একই ভাবে। জঙ্গলের মাটি পর্যন্ত তারা যেমন কখনো সূর্যের আলোর রেখা পৌঁছোতে দেয় নি, তেমনই পৌঁছোতে দেয় নি ক্রমোন্নত সভ্যতার আঁচটুকুও। ঘন সবুজ আবরণে ঘেরা আমাজনের জঙ্গল তাই হয়ে উঠেছে রোমাঞ্চকর রহস্যের আখড়া।
২৫ ফুট লম্বা অ্যানাকোন্ডা থেকে শুরু করে মানুষখেকো পিরানহা, আমাজনের বিস্ময়ের শেষ নেই। সেই বিস্ময়ের তালিকাতেই আছে আরো এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক নির্মাণ। ‘শানায় টিম্পিসখা’। এটি আমাজনের গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা এক নদী। কিন্তু এ কোনো সাধারণ নদী নয়। এটি পৃথিবীর উষ্ণতম নদী।
আমাজনের ‘শানায় টিম্পিসখা’ নদীর বৈশিষ্ট্য:
আমাজন অরণ্যের মাঝ বরাবর বয়ে চলা এই নদীর জল প্রচন্ড গরম। সর্বক্ষণ টগবগ করে ফুটছে। মাছ তো দূরের কথা, কোনো জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ, কিছুরই অস্তিত্ব নেই এই নদীতে। ৪ মাইল বা ৬.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫ মিটার চওড়া ও ৬ মিটার গভীর নদী এই আমাজনের ‘শানায় টিম্পিসখা’। এখানকার নদীর জলের স্ফুটনাঙ্ক ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আমাজনের ‘শানায় টিম্পিসখা’ নদীর পৌরাণিক ইতিহাস:
দক্ষিণ আমেরিকার পেরু দেশের আমাজন অরণ্যে বইছে ‘শানায় টিম্পিসখা’। পৌরাণিক গল্প কথা অনুযায়ী এই অঞ্চলে এক কালে বাস করত ইনকা জনজাতি। ইনকাদের কাছে এই নদী ছিল সূর্যদেবের জলস্রোত। সূর্যের তাপেই ফুটছে নদীর জল, এমনটাই বিশ্বাস ছিল প্রাচীন এই জনজাতির। ইনকারা ছিল সূর্য দেবের উপাসক। নিজেদের কথ্য ভাষায় তারাই এই নদীর নাম রেখেছিল ‘শানায় টিম্পিসখা’। শুধু তাই নয়, স্পেনীয় বাহিনী, যাঁরা ইনকা সভ্যতা জয় করার জন্য অভিযানে সামিল হয়েছিলেন, তাঁদের বিবরণেও আছে এই নদীর কথা।
আমাজনের ফুটন্ত নদীর রহস্য উদঘাটন:
কেন কীভাবে ফুটছে শানায় টিম্পিসখার জল? কোথা থেকে আসছে এত উত্তাপ? এর উত্তর, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বহু বছর ছিল অজানা। অবশেষে নিজের চেষ্টায় আর অজানার প্রতি অদম্য আকর্ষণে শানায় টিম্পিসখার রহস্য ভেদ করেন পেরুর বাসিন্দা আন্দ্রে রুজো।
আর পাঁচ জনের মতো আন্দ্রে রুজোও এই ফুটন্ত নদী সম্পর্কে প্রচলিত লোককথা শুনেই বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক রুজোকে আজগুবি কাহিনী আশ্বাস বা স্বস্তি দিতে পারে নি। তাই কিশোর বয়স থেকেই তাঁর মনে শানায় টিম্পিসখার রহস্য ভেদ করার ইচ্ছে ছিল প্রবল। কৈশোর থেকে শুরু করে টানা ১২ বছর ধরে এই নদীর অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিলেন আন্দ্রে রুজো।
এরপর বড় হয়ে আন্দ্রে রুজো পেরু থেকে পড়াশোনা করতে টেক্সাসে যান। সাদার্ন মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। বিষয় ছিল, জিয়োফিজিক্স। বলা বাহুল্য, ফুটন্ত নদীর রহস্য কিন্তু তখনও মাথায় ঘুরছে তাঁর।
এ সময় আন্দ্রে রুজো তৈরি করেন পেরুর থার্মাল-ম্যাপ বা তাপমানচিত্র। পেরু জুড়ে বিস্তৃত জিয়ো থার্মাল বৈশিষ্ট তাঁকে বিস্মিত করে।ধীরে ধীরে আন্দ্রে বুঝতে পারেন ফুটন্ত নদীর অস্তিত্ব আছে।
কেন ফুটছে আমাজনের নদী?
আন্দ্রে রুজো গবেষণার পর দেখেন, শানায় টিম্পিসখা সূর্যদেবের তাপে নয়, ফুটছে পৃথিবীর ভূভাগের অভ্যন্তরস্থ তাপে। এরপর নিজের চোখে রহস্যভেদ করতে ২০১১-র নভেম্বরে পেরুর মধ্য অংশে অভিযানে যান আন্দ্রে রুজো।
নদীর কাছেই মায়ানটুয়াকু গ্রামে আন্দ্রে রুজো বাঁধা পান। সেই গ্রামের পুরোহিতরা নদীর কাছে যেতে দেন না বহিরাগতদের। কারণ ওই নদীর জল তাঁরা ব্যবহার করেন ওষধি হিসেবে। ফলে তার হদিশ রাখতে চান গোপনই। বহু চেষ্টার পর অবশেষে মেলে অনুমতি।
আন্দ্রে রুজো নদীর কাছে পৌঁছে দেখেন, উষ্ণ প্রস্রবণের মতো নিজের খেয়ালেই সে বেরিয়েছে পাথরের চাঁইয়ের ফাঁক দিয়ে। তারপর নিজের যাত্রাপথ শেষ করে সে একসময় মিশে গিয়েছে আমাজন নদীর সঙ্গে।আন্দ্রে দেখতে পান, ধোঁয়া ওঠা ফুটন্ত সেই স্রোত বেয়ে ভেসে চলেছে প্রাণীদের ঝলসে যাওয়া দেহ। যা সবথেকে বীভৎস, তা হল মৃত প্রাণীগুলির গলে সাদা হয়ে যাওয়া চোখ।
আমাজনের শানায় টিম্পিসখা কি অদ্বিতীয়?
আমাজনের শানায় টিম্পিসখা নদী কিন্তু বিশ্বের এক এবং অদ্বিতীয় ফুটন্ত নদী নয়। বিরল হলেও ফুটন্ত নদী আরও আছে পৃথিবীতে। তবে সেগুলির কাছে হয় আগ্নেয়গিরি বা চৌম্বকীয় ক্ষেত্র আছে। আমাজনের শানায় টিম্পিসখা নদী থেকে নিকটবর্তী সক্রিয় আগ্নেয়গিরির দূরত্ব ৪০০ কিমি। তা ছাড়া পেরুর আমাজনে কোনও চৌম্বকীয় ক্ষেত্রও নেই। একারণেই রহস্যময় এই নদী।
আন্দ্রে ও তাঁর সহকারী গবেষকদের মত, এর কারণ ভূগহ্বরের তাপমাত্রা। তাঁদের মতে, পেরুর আমাজন অরণ্যের এই গভীরে শিলাময় ভূভাগে চ্যুতি বা ফাটল অনেক বেশি। সেখান দিয়ে বৃষ্টির জল প্রবেশ করে ভূভাগের ভিতরে। এরপর আবার তা ওপরে উঠে আসে। ফলে তার তাপমাত্রা পূর্বের চেয়ে শত গুণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ জিয়োথার্মাল বা হাইড্রোথার্মাল চক্রের বিক্রিয়া নদীর জলকে ফুটন্ত করে তুলেছে।
আমাজনের ফুটন্ত নদী শানায় টিম্পিসখা সম্পর্কে নিজের সমস্ত গবেষণা এবং অভিজ্ঞতা আন্দ্রে রুজো লিখে রেখেছেন তাঁর ‘দ্য বয়েলিং রিভার: অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড ডিসকভারি ইন আমাজন’ নামক গ্রন্থে।