এই মুহূর্তে করোনা আতঙ্কে গোটা দেশ থরহরি কম্প। কিভাবে পরিস্থিতির সামলানো যাবে তা কোনমতেই ভেবে পাচ্ছে না সরকার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা যে সমস্ত পদক্ষেপের নিদান দিচ্ছেন তা এক রকম অসম্ভব ঠেকছে কেন্দ্রের কাছে। বলা যেতে পারে ভারত সরকার এরই মধ্যে কোনরকমে নিজেদের মতো করে ঠেকনা দেওয়া কিছু কাজ করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে।
ভারত অক্সিজেন উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে প্রথম। কিন্তু দেশে মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশ থেকে চিকিৎসা পরিসেবায় ব্যবহার উপযুক্ত অক্সিজেন আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এই একটা তথ্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে দেশে করোনা সঙ্কট ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে ভারতের চিরাচরিত চরিত্র অনুযায়ী কালোবাজারি, সুযোগের অপব্যবহার করার মতো অজস্র ব্যাপার ঘটছে। এতে সাধারণ নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষ আরও বিপদে পড়ে যাচ্ছেন।
এই পরিস্থিতি সামলানোর জন্য গণ টিকাকরণ একমাত্র পথ হিসেবে সামনে উঠে আসছে। এক্ষেত্রে আদর্শ উদাহরণ ব্রিটেন। তারা এই অল্প কয়েকদিনের ভিতরে দেশের বেশিরভাগ বাসিন্দাকে করোনা টিকার দুটি ডোজ প্রদান করে দেওয়ায় সে দেশে করোনার ভয়াবহতা একদম নেই বলতে গেলে। এখন ব্রিটেনে গড়ে এক থেকে দেড় হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হন। এই পরিমান করোনা আক্রান্ত মানুষকে সঠিক চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া এই প্রথম বিশ্বের দেশটির কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। এখান থেকেই উঠে আসছে করোনার মোকাবিলা করতে হলে ভারতেও দ্রুত সমস্ত মানুষকে টিকাকরণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক যে কোনও মানুষ করোনা টিকা পাবে। একমাত্র তার যদি শারীরিক কোনও সমস্যা থাকে তবে চিকিৎসকরা যা অনুমতি দেবেন সেই অনুযায়ী গোটা বিষয়টি ঘটবে। অথচ এ দেশে করোনা টিকার অপ্রতুলতা যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনই এর দাম গরিব মানুষকে ব্যাপক সমস্যায় ফেলে দিয়েছে।
দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি চিকিৎসকদের একটা বড় অংশও জানিয়েছেন এরকম একটি মহামারীর মোকাবিলা করতে হলে প্রতিটি মানুষকে বিনামূল্যে টিকা প্রদান করা উচিত। এক্ষেত্রে তারা অনেকগুলি যুক্তি সামনে তুলে এনেছেন। ভারতের এই ভয়ঙ্কর অবস্থা সামলাতে বিনামূল্যে টিকাকরণ কেন জরুরি তা আজ আমরা আলোচনা করব।
১) গরিব মানুষের ক্ষেত্রে অর্থ যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়-
ভারতে প্রস্তুত দু’টি করোনা টিকা কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাকসিনের দু’টি করে ডোজ নিতে হলে সাধারণ মানুষকে গড়ে ৬০০ থেকে ১,২০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হবে। এই অর্থ খরচ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অর্থ খরচ করতে না পারলে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ টিকাকরণ প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। সেই কারণেই টিকাকরন প্রক্রিয়া পুরো বিনামূল্যে করে দেওয়া উচিত।
প্রশ্ন জাগতে পারে দিন আনি দিন খাই মানুষরা এককালীন ৬০০ টাকা খরচ করতে পারবেনা না কেন? ধরে নিন একটি পরিবারের কমপক্ষে চারজন সদস্য আছে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেককে যদি ঠিকা নেয় তবে পরিবারটির খরচ হবে কমপক্ষে ২,৪০০ টাকা। দিন আনি দিন খাই মানুষের পক্ষে এককালীন এতোগুলো টাকা খরচ করাটা প্রায় অসম্ভব। ভারতের জনসংখ্যার কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মানুষ এই শ্রেণীর অন্তর্গত। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন করোনা টিকাকরণের মাধ্যমে এই মহামারীকে আটকাতে হলে প্রতিটি মানুষকে এই টিকা প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ দেশের জনগণের একটা বড় অংশ যদি অর্থের অভাবে টিকা নিতে না পারে তবে গোটা উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে।
২) মানসিক বাধা দূর করা-
ভারতের একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে আজও অর্থ নিয়ে মানসিক বাধা আছে। তারা নিজের ইচ্ছে ছাড়া সার্বিক মঙ্গলের লক্ষ্যে কোনও কিছু করতে চায় না। এদেরকে যদি বলা হয় তুমি অল্প কিছু টাকা খরচ করে করোনার টিকা নিয়ে নাও, এই অংশের মানুষ কখনই টিকা গ্রহণ কেন্দ্রের দিকে যাবে না।
অথচ এই মানুষদেরকেই যদি বিনামূল্যে করোনা টিকা দিয়ে তাদেরকে টিকা গ্রহণে বাধ্য করা যায় তাহলে মূল উদ্দেশ্য সফল হবে। বাধ্য করতে হবে, না হলে টিকাকরণ সম্ভব নয়। এবার আপনি যদি অর্থের বিনিময়ে টিকাকরন প্রক্রিয়া চালান তবে কখনোই কাউকে তা নিতে বাধ্য করতে পারবেন না। সেই কারণেই বড় উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিনামূল্যে এই পরিষেবা প্রদান করতে হবে। কারণ মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা সময় এখন নেই। প্রথম লক্ষ্যই হল এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়লাভ করা।
৩) কালোবাজারি আটকানো-
সাধারণ মানুষকে যদি টাকার বিনিময়ে করোনা টিকা কিনতে হয় তবে কালোবাজারি অনিবার্য বিষয়। অথচ সরকার যদি যাবতীয় টিকাকরণের দায়ভার গ্রহণ করে দেশের প্রতিটি মানুষকে বিনামূল্যে সেই পরিষেবা প্রদান করে তবে কালোবাজারি ঘটার কোনও সম্ভাবনা থাকবে না। কারণ এক্ষেত্রে পুরো বিষয়টাই সরকারি নিয়ন্ত্রণে ঘটবে। তাছাড়া টিকার বাজারমূল্য বলে আলাদা করে কিছু থাকবে না। এই পরিস্থিতিতে সরকার পূর্বপরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের প্রতিটি মানুষকে টিকা প্রদান করতে সক্ষম হবে।
৪) জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব সরকারের-
যে অসুখ বা রোগের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত সেখানে সরকার বাহাদুর কখনোই নিজেদের ভূমিকায় এড়িয়ে যেতে পারে না। বরং ব্যাবসায়িক মনোভাব বাদ দিয়ে এ রকম পরিস্থিতিতে যাবতীয় দায়-দায়িত্ব সরকারের উচিত নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া। সেই কারণেই করোনা পরিস্থিতিতে তার টিকা নিয়ে যেমন বাণিজ্য হতে দেওয়া চলবে না, তেমনই মানুষের স্বাস্থ্যের মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়েও সরকারকে পুরোপুরি এগিয়ে আসতে হবে। কারণ জনস্বাস্থ্য কখনও মুনাফা সন্ধানীদের হাতে তুলে দিয়ে সামলানো যায় না। আর তা যদি বেসরকারি ব্যবস্থার সাহায্যে সামলানোর চেষ্টা করা হয় তবে সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে পরিষেবার সুযোগ থেকে চিরস্থায়ীভাবে বঞ্চিত থেকে যাবে। এর ফলে শুধু যে সেই মানুষগুলোর ক্ষতি হবে তা নয়। এরকম একটি সংক্রামক ভাইরাসের আওতায় পড়ে জীবন বিপন্ন হবে সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষদেরও।
৫) জাল টিকার চক্কর থেকে উদ্ধার পাওয়া-
এই দেশ অতীতে বারবার জাল ওষুধ এবং জাল টিকার কারবার দেখেছে। এদিকে করোনা এমন একটি মারন ভাইরাস যে একটা মানুষ আক্রান্ত হলে তা শত হাজার জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই অর্থের বিনিময় করোনা প্রতিরোধী টিকার কেনাবেচা চললে অসাধু ব্যবসায়ীরা তা জাল করার চেষ্টা করতে পারে। সেক্ষেত্রে উপকারের বদলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অথচ এই টিকার যদি নির্ধারিত কোনও মূল্য না থাকে তবে তা জাল করার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না কারণ মুনাফা থাকলে তবেই অসাধু ব্যবসায়ীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর যেখানে অর্থের কোনও লেনদেন নেই সেখানে তাদের স্বার্থ না থাকার কারণেই তারা এগিয়ে আসবে না।
এছাড়া দেশে নানা রকম টিকার প্রচলন থাকায় এক একজন এক এক দামে টিকা কিনতে হবে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এর ফলে সমাজে অসন্তোষ ও বৈষম্য তৈরী হতে পারে। অথচ বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হল এই অসন্তোষ ও বৈষম্য নির্মূল করা সম্ভব হবে।