কংগ্রেসী ঘরানার রাজনীতিতে আমরা সবসময়ই দেখে এসেছি গোষ্ঠী রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত থাকে। সেই কংগ্রেস থেকে জন্ম হওয়া তৃণমূলের মধ্যে যে এই একই বৈশিষ্ট্য থাকবে তা খুবই স্বাভাবিক। তৃণমূলের মূল কান্ডারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধীতা করবে, দলের মধ্যে এরকম কেউ না থাকলেও তার পরবর্তী স্তরের নেতৃত্তের মধ্যে গোষ্ঠী বিভাজন বেশ ভালোমতোই লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত একটি অঞ্চলে দুজন শক্তিশালী নেতা থাকলে তো আর কথাই নেই। চিরসত্যর মতো সেক্ষেত্রে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে তৃণমূলে। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যে শুধু কলকাতা ও তদসংলগ্ন অঞ্চলে দেখা যায় তা কিন্তু নয়। রাজ্যের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে আছে তৃণমূলের গোষ্ঠী রাজনীতি। আমরা বরং সেরকম উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনার ওপর নজর দিই।
১) উত্তর কলকাতায় শশী পাঁজা বনাম সাধন পান্ডে
তৃণমূলের গোষ্ঠী রাজনীতিতে উত্তর কলকাতায় একাধিক সমীকরণ লক্ষ্য করা যায়। দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা শশী পাঁজা এবং সাধন পান্ডে দুজনেই রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য। তা সত্ত্বেও এই দুই নেতার অনুগামীদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষ ঘটে এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে।
প্রয়াত অজিত পাঁজা সঙ্গে সাধন পান্ডের দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। পরবর্তীতে অজিত পাঁজার পুত্রবধূ শশী পাঁজা রাজনীতিতে আসলে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তার সঙ্গে বিবাদ বাধে সাধন পান্ডের। যা আজও চলছে।
২) সাধন পান্ডে বনাম পরেশ পাল
উত্তর কলকাতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠী রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি চরিত্র কমন, সাধন পান্ডে। সাধন পান্ডে গোষ্ঠীর সঙ্গে পরেশ পাল গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব মাঝেমধ্যেই শালীনতা ছাড়িয়ে কলতলার খেউরে পরিণত হয়। স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী হস্তক্ষেপ করেও এই দুই নেতার মধ্যে সমস্যা মেটাতে পারেননি। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে একুশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই দুই নেতার কোনো একজন দল পরিবর্তন করে বিজেপিতে যোগ দেবেন। যার মূল কারণ আদর্শ নয়, গোষ্ঠী রাজনীতি!
৩) হাওড়া জেলায় অরূপ রায় বনাম রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়
হাওড়া জেলা তৃণমূল আড়াআড়িভাবে অরূপ রায় এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় গোষ্ঠীতে বিভক্ত। ওই জেলার এই দুই নেতাই রাজ্য মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, কিন্তু স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে তাদের মতবিরোধ একাধিকবার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। এই দুই নেতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে অতিসম্প্রতি অরূপ রায়কে জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে রাজ্যের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্লকে জেলা সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। যদিও তারপরেও এই দুই নেতার দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সমস্যা মেটেনি।
৪) সিঙ্গুরে বেচারাম মান্না বনাম রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
হুগলি জেলার সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের ওপর ভর করে এই রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু সেই সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পাশের কেন্দ্র হরিপালের বিধায়ক বেচারাম মান্নার দ্বন্দ্ব রাজ্য রাজনীতিতে বেশ মুচমুচে খবর। বেচারাম মান্না হরিপালের বিধায়ক হলেও তিনি সিঙ্গুরের সাংগঠনিক ক্ষমতা নিজের গোষ্ঠীর লোকেদের হাতে রাখতে চান বলে অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের। মাস্টারমশাই নামে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য এই বিষয়ে কয়েকদিন আগেই দলত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
৫) ভাঙরে আরাবুল ইসলাম বনাম কাইজার আহমেদ
ভাঙরের বেতাজ বাদশা নামে পরিচিত প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলামের সঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সদস্য কাইজার আহমেদের লড়াই দীর্ঘদিনের। এই দুই নেতার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে এর আগে ভাঙর বিধানসভা তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছিল। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে গতবারের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই(এম) থেকে আসা রেজ্জাক মোল্লাকে প্রার্থী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও বয়সের কারণে রেজ্জাক অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ভাঙ্গড়ের ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে ওই দুই নেতার মধ্যে আবার লড়াই শুরু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
৬) পূর্ব মেদিনীপুরে অধিকারী পরিবার বনাম অখিল গিরি
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলে অধিকারী পরিবার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করলেও ওই জেলার রামনগরের বিধায়ক অখিল গিরি রাজ্য রাজনীতিতে অধিকারীদের বিরোধী শিবিরের নেতা হিসাবে সুপরিচিত। শিশির অধিকারী জেলা তৃণমূলের সভাপতি হিসাবে বহাল থাকলেও অখিল বাবুকে সাম্প্রতিক সময়ে জেলার কার্যকারী সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয় দল। তার পরই তিনি অধিকারীদের বিরুদ্ধে আরও সরব হয়ে উঠেছেন। শুভেন্দু অধিকারী অতিসম্প্রতি রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর তাকে নিয়ে কটূক্তি করেন এই বর্ষীয়ান তৃণমূল বিধায়ক। যার ফলে অধিকারীদের সঙ্গে তার টানাপোড়েন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
৭) কোচবিহারে পার্থপ্রতিম রায় বনাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ
লোকসভা নির্বাচনে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে হাতছাড়া হওয়ার পর জেলা সভাপতির পদ থেকে রাজ্যের মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে সরিয়ে দিয়ে প্রাক্তন সাংসদ পার্থপ্রতিম রায়কে সেই দায়িত্ব দেয় তৃণমূল। দলের পক্ষ থেকে সমস্ত নেতাকে মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করার কথা বলা হলেও, কোচবিহার জেলা তৃণমূল এই মুহূর্তে পার্থপ্রতিম রায় ও রবীন্দ্রনাথ ঘোষ এই দুই গোষ্ঠীতে আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত। একাধিক দলীয় কর্মসূচি এই দুই গোষ্ঠীর কর্মীদের মধ্যে মারামারির কারণে পন্ড হয়ে যেতেও দেখা গিয়েছে। এই দুই নেতার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিরক্ত হয়ে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক তৃণমূল কর্মী দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান পর্যন্ত করেছেন।
৮) মালদায় সাবিত্রী মিত্র বনাম কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী
এই দুজনেই কংগ্রেস ত্যাগ করে পরবর্তী সময়ে তৃণমূলে যোগদান করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুই নেতাকে একসময় তার মন্ত্রিসভার সদস্য করেছিলেন। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে এই দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগামছাড়া হলে দু’জনকেই মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন। মালদা জেলা তৃণমূল বরাবরই সাবিত্রী এবং কৃষ্ণেন্দু শিবিরে বিভক্ত। শত চেষ্টা করেও এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।
৯) দক্ষিণ দিনাজপুরে বিপ্লব মিত্র বনাম অর্পিতা ঘোষ
তৃণমূলের জেলা সভাপতি থাকাকালীন বিপ্লব মিত্র একাধিকবার লোকসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় নেতৃত্ব তার কথায় কর্ণপাত না করে কলকাতার পরিচিত নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষকে প্রার্থী করে। প্রথমবার নির্বাচনে জয়লাভ করলেও ২০১৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিপ্লব গোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে তৃণমূলের হাতছাড়া হয় বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রটি। এরপরই ক্ষুব্দ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা সভাপতির পদ থেকে বিপ্লব মিত্রকে সরিয়ে অর্পিতা ঘোষকে সেই পদে বসান। এর কিছুদিন পরই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন বিপ্লব বাবু এবং তার অনুগামীরা। যদিও বিজেপির দলীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে পরবর্তী পর্যায়ে তিনি তৃণমূলে ফিরে আসেন। বিপ্লব মিত্র তৃণমূলে ফিরে আসলেও তার সঙ্গে অর্পিতা ঘোষের দ্বন্দ্ব এখনো একই রকম আছে।
১০) নানুরে গদাধর হাজরা বনাম কাজল শেখ
বীরভূম জেলার নানুর বিধানসভা কেন্দ্র এই দুই নেতার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে একাধিকবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মারামারির ফলে বোম ও গুলির শব্দের সঙ্গে একসময় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল নানুরের বাসিন্দারা। পরবর্তী পর্যায়ে পুলিশ দিয়ে এখানকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি করা সম্ভব হলেও এই দুই নেতার দ্বন্দ্বের ফলে অশান্তির চোরাস্রোত আজও বয়ে চলে নানুরে।
তৃণমূল সাংগঠনিকভাবে ততটা শৃঙ্খলাবদ্ধ না হওয়ায় এই দলের প্রায় প্রতিটি পৌরসভা ও পঞ্চায়েত স্তর থেকেই গোষ্ঠী রাজনীতি দেখা যায়। এই গোষ্ঠী রাজনীতি যখন আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে অবতীর্ণ হয় তখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে অনেক সময়ই নির্বাচনে তৃণমূলের ফলাফল খারাপ হতেও দেখা যায়।