‘তোমার নাম, আমার নাম, হৃদয় মাঝে নন্দীগ্রাম।’ ‘ভুলতি পারি সবার নাম, ভুলবো নাকো নন্দীগ্রাম।’ স্লোগানগুলো ক বছর আগের নির্বাচনে ঝড় তুলেছিল। এবার সেখানে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের স্লোগান, নন্দীগ্রাম যার, নবান্ন তার। আসলে নন্দীগ্রাম আসনে এবার এমন একটা নির্বাচন হতে চলেছে যা শুধু হাইপ্রোফাইল বললে কম বলা হবে, বলা ভাল, হাই ইনডিকেটিভ বা বড় ইঙ্গিতবাহী ভোট। কিন্তু রাজ্যের ২৯৪টি আসনের মধ্যে হঠাৎ করে নন্দীগ্রাম এত গুরুত্বপূর্ণ আসন হয়ে গেল কেন, যার জন্য বলতে হচ্ছে নন্দীগ্রাম যার, নবান্ন তার!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে এই প্রথম কলকাতা বা শহরতলীর গণ্ডি ছাড়িয়ে জেলার কোনও আসনে প্রার্থী। প্রতিপক্ষ শুভেন্দু অধিকারী। যে শুভেন্দুই ছিলেন নন্দীগ্রাম জয়ে মমতার প্রধান সেনাপতি। যে নন্দীগ্রাম আন্দোলন মমতাকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কাঙ্খিত সাফল্য এনে দিয়েছিল। পূর্ব মেদিনীপুরের সেই জায়গাই এবারের ভোটে মমতার সবচেয়ে বড় দাঁড়িপাল্লা।

নির্বাচনী গবেষকরা বলছেন, নন্দীগ্রাম আসনে শুভেন্দু যদি পদ্ম ফোটাতে পারেন, তাহলে গোটা রাজ্যে জোড়া ফুল যে কাত হয়ে যাবে সেটা নিশ্চিত। কারণ দিদির নন্দীগ্রামে হার মানেই, এটা নিশ্চিত দশ বছর সরকার চালানোর অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি বা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে লোকের ক্ষোভ তীব্র ছিল। ২০০৪ লোকসভা নির্বাচনে গোটা রাজ্যে তৃণমূল সর্বত্র পরাস্ত হয়, সেই ভরাডুবির মধ্যেও মমতা কিন্তু নিজের কেন্দ্রে জিতেছিলেন। তাই বলাই বাহুল্য এবার নন্দীগ্রামে দিদি হারলে গোটা রাজ্যে যে তৃণমূলের হার কার্যত নিশ্চিত।

আর উল্টোটা হলে? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মুখ্যমন্ত্রী নিজের কেন্দ্রে জিতলেও ক্ষমতা হাতছাড়া হয় তার। তাই সাদা চোখে বললে মনে হতেই পারে, দিদি জিতলেও তৃণমূল ক্ষমতায় ফিরবে এমনটা বলার কারণ নেই। কথাটা এমনিতে সত্যি মনে হবে। কিন্তু সেফলজিস্ট বা ‘নির্বাচনী অঙ্কবিদ’-রা বলেন, যেসব ভোটে দু পক্ষই তুল্যমূল্য অবস্থায় থাকে, অঙ্কের হিসেবে যাকে বলে ৫০:৫০ ভোট, সেখানে দলের প্রধান মুখ যে কেন্দ্রে দাঁড়ান সেই কেন্দ্রের ফলাফল সবচেয়ে বড় ইঙ্গিতবহ ফলাফল হয় রাজ্য বা দেশের।

আমাদের রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে একই রকম প্রবণতা বারবার দেখা গিয়েছে। তা সে ২০১৬ই হোক, বা ২০০১। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি প্রার্থী হয়ে বড় জয় পেয়েছিলেন, দলও বড় জয় পায়। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে আবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে যাদবপুর থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আবার ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচনে যাদবপুর থেকে ৫৮ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতেছিলেন বুদ্ধদেব, তাঁর দল বা ফ্রন্টও রেকর্ড ২৩৫টি আসনে জিতে ক্ষমতায় ফিরেছিল। ২০০১ বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে লড়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জিতেছিলেন বড় ব্যবধানে, বামফ্রন্টও বড় সংখ্যা নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। আর ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬- পরপর পাঁচবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাতগাছিয়া কেন্দ্র থেকে জিতে এসেছেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্য়োতি বসু।

তথ্যগুলো এই কারণেই দেওয়া যাতে বোঝা যায়, আমাদের রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের প্রবণতা হল, মুখ্যমন্ত্রী হারলে দলের ভরাডুবি হয়। আর মুখ্যমন্ত্রী জিতলে শাসক দল সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়।

এবারের ভোট অবশ্য সব দিক থেকেই ব্যতিক্রমী। এভাবে দল বদলের হিড়িক, রাজ্যের মন্ত্রী-বিধায়কদের ফুল বদল, দেশের শাসক দল একেবারে অল আউট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের মত হাই-প্রোফাইলদের বিধানসভা ভোটের প্রচারে বারবার রাজ্যে আসা। এত কিছু এর আগে কোনও বিধানসভা নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করেনি বাংলা। দল বদলের হিড়িক, হেভিওয়েটদের ফুল বদল, লোকসভা ভোটে বিজেপি-র অপ্রত্য়াশিত হারে ভোট বাড়া, বাম ভোটে ধসের ফলে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে নানা সমীকরণ, সম্ভবনা তৈরি হয়েছে। তবু বলাই যায়, নন্দীগ্রামের ফলই হয়তো শেষ পর্যন্ত রাজ্যের ফলের বড় আভাস হয়ে যেতে পারে।