বিধানসভা নির্বাচন এখন অতীত। ফল প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। হাজার লম্পঝম্পের পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনেক দূরে থেমে গিয়েছে বিজেপির দৌড়। তারা মাত্র ৭৭ টি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে। অথচ দু’বছর আগের লোকসভা ভোটের ফল দেখলে দেখা যাবে সেই সময়ে তারা রাজ্যের ১২৮ টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে মাত্র দু’বছরে বিজেপি ৫১ টি আসন খুইয়েছে। তবে ভোটের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে লোকসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি যা ভোট পেয়েছিল তার থেকে বিধানসভা নির্বাচনে তাদের ভোট ২ শতাংশ কমে গিয়েছে। অন্যদিকে তৃণমূলের ভোট প্রায় ৭ শতাংশের কাছাকাছি বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির এই হতশ্রী ফলের পর প্রশ্ন উঠেছে আসন্ন পুরসভা নির্বাচনে বিজেপির কি আদৌ কোনও সুযোগ আছে? কেমন হতে চলেছে বাংলার পুর নির্বাচনের ফল? এক্ষুনি পুরসভার ভোট হচ্ছে না এ রাজ্যে। তবে করোনা পরিস্থিতি সামলে ওঠা গেলেই পুর নির্বাচন হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। এই সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করেই আমরা বিচার করে দেখব পুরসভা ভোটে বিজেপির পক্ষে আদৌ কতটা কি করা সম্ভব। কেমন হতে চলেছে বাংলার পুর নির্বাচনের ফল সেটাও আমরা বোঝার চেষ্টা করব এই প্রতিবেদনে।


১) বিজেপির সাফল্যের সম্ভাবনা বেশ কম-

পুরসভা ভোটের সঙ্গে বিধানসভা, লোকসভা নির্বাচনের অনেকটাই পার্থক্য আছে। এক্ষেত্রে দলের থেকে প্রার্থীর ভাবমূর্তি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেই জন্য বিজেপির সম্ভাবনা কম বলে মনে করছি আমরা। কারণ বিজেপির স্থানীয় স্তরে সংগঠন এখন‌ও পর্যন্ত শক্তিশালী নয়। সেই কারণেই তাদের দলের স্থানীয় স্তরে নেতার অভাব আছে। তাই পুরসভা নির্বাচনে প্রতিটি ওয়ার্ডে উপযুক্ত প্রার্থী দেওয়া যথেষ্ট মুশকিল তাদের পক্ষে।

মানুষের মনের আবেগের ওপর নির্ভর করে সার্বিকভাবে বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন উৎরে যাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু পুরসভা নির্বাচনে যেহেতু স্থানীয়ভাবে পরিষেবা এবং প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও জনসংযোগ মূল বিষয় হয়ে ওঠে সেই জন্য অবশ্যই তৃণমূল অনেকটাই এগিয়ে আছে। শুধু তারা রাজ্যের শাসক দল বলে এগিয়ে আছে তাই নয়, তাদের বেশিরভাগ প্রার্থী দুর্গা পুজো সহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকে বলে অবশ্যই অ্যাডভান্টেজ অবস্থায় আছে তারা।


২) তৃণমূলের কাঁটা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব-

বিধানসভা নির্বাচনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যতটানা প্রকট হয়ে উঠেছে স্থানীয় স্তরের নির্বাচন অর্থাৎ পুরসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটে সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পুরসভা নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে গৃহবিবাদের সমান। দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ধামাচাপা দিতেই এর আগে নির্ধারিত সময়ে পুরসভার ভোট করাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এই বিপুল জয়ের পর তিনি যখনই পুরসভার নির্বাচন করবেন রাজ্যে তখনই দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসবে এটা নিশ্চিত।

তৃণমূলের এই প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি যদি সুযোগ করে নিতে পারে তাহলে জোড়া ফুলকে চেপে ধরে শীর্ষে উঠে আসতে পারে পদ্ম ফুল। এমনিতেই তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ কম নয়। লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে ভোট দিলেও পুরসভার ভোটে তৃণমূল নেত্রী খুব একটা বড় ফ্যাক্টর নয়। তাই তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্দ্ব বিজেপির কাছে একটা বড় সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।


৩) কলকাতায় দ্বিতীয় হয়েই থাকতে হবে পদ্ম শিবিরকে-

বিধানসভা নির্বাচনে কলকাতার ফলাফল থেকে একটুকু পরিষ্কার বিজেপির অবস্থা এখানে খুব একটা সুবিধার নয়। কলকাতা পুরসভা তৃণমূল আমলে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। সব মিলিয়ে কলকাতা পুরসভা দখলের দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ না দিয়ে মফস্বলের পুরসভাগুলি কব্জা করার দিকে নজর দিলে বিজেপি সবচেয়ে বেশি সাফল্য পাবে।

কলকাতা পুরসভায় অতিরিক্ত শক্তি খরচ করা বিজেপির কাছে অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তার বদলে শিলিগুড়ি, আসানসোলের মতো পুরসভাগুলিতে তারা যদি অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে তবে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম বিজেপি মেয়র পেলেও পেতে পারে। এছাড়া মফস্বলের পুরসভাগুলোতে বিজেপির ভালো ফল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।


৪) দল ভাঙানোয় নয়, সংগঠন গড়ায় মন দিক-

বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবির অন্যতম কারণ বাছবিচার না করে তৃণমূল থেকে একের পর এক নেতাদের নিজেদের দলে সামিল করা। গেরুয়া শিবিরকে বুঝতে হবে যে তৃণমূল নেতাদের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আছে তাদেরকে দলে নিলে হিতের পরিবর্তে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। পুরসভা নির্বাচনে তৃণমূলের যারা কাউন্সিলর তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। তাই চটজলদি সাফল্য লাভের আশায় টিকিট না পাওয়া তৃণমূলের দলীয় প্রার্থীদের দলে সামিল করলে পুর নির্বাচনেও ভুগতে হবে বিজেপিকে।

পুর নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়াতে হলে গেরুয়া শিবিরকে ইতিমধ্যেই সংগঠন শক্তিশালী করে তোলার কাজে মন দিতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে, প্রতিটি পাড়ায় বেশ কয়েকজন করে উজ্জ্বল ভাবমূর্তির স্থানীয় বাসিন্দাকে নিজেদের দলে সামিল করতে পারাটা তাদের সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারে। পুর নির্বাচনে জাতপাতের রাজনীতি করলে আবারও ভুগবে বিজেপি। বরং তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত জন পরিষেবা এবং স্থানীয় ইস্যুগুলি।


৫) সমস্ত ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারা-

পুর নির্বাচনে বিধানসভা ভোটের মত কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে না। স্বাভাবিকভাবেই শাসকদলের দাপট অনেক বেশি থাকবে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারা‌ই অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ গেরুয়া শিবিরের কাছে। তাই পুর নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়াতে হলে বিজেপিকে আগে নিশ্চিত করতে হবে তারা যাতে প্রতিটি পুরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারে। তাদের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে নিচুতলার কর্মী পর্যন্ত প্রত্যেককে এই বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। তবেই তৃণমূলের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা সম্ভব হবে।