ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে স্বীকৃতি প্রদান,দলগুলির নির্বাচনী প্রতীক নির্ধারণ এবং তাদের মধ্যে কোন দলগুলি জাতীয় দলের মর্যাদা পাবে ও কোন দলগুলি রাজ্য দলের মর্যাদা পাবে সেই সিদ্ধান্তের পুরোটাই জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলিকে জাতীয় দল এবং রাজ্য দল হিসাবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নির্দিষ্ট একটি নিয়ম বা ফর্মুলা আছে। সেই অনুযায়ী যে দলগুলি যোগ্যতা মান পেরোতে সক্ষম হয় তারা জাতীয় দলের স্বীকৃতি পায়।
সম্প্রতি বিহার বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বেশ খারাপ ফলাফল করে। তারা বিরোধী মহাজোটের শরিক হিসাবে ৭০ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ১৯ টি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। এরপরই বিজেপি সহ নানান রাজনৈতিক মহল থেকে বলা হতে থাকে কংগ্রেস তার সর্বভারতীয় পরিচিতি হারিয়ে এবার আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হবে।
বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় থাকলেও এটা অনস্বীকার্য যে এখনো পর্যন্ত দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। ভারতের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই হল বিজেপি এবং কংগ্রেস। বিজেপি বিরোধী অনেকগুলি রাজনৈতিক থাকলেও তাদের মধ্যে বেশিরভাগের প্রতিপত্তি একটি নির্দিষ্ট আঞ্চলিক সীমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। একমাত্র কংগ্রেসের গোটা দেশ জোড়া বিস্তার আছে। তাই এক্ষেত্রে বিজেপির দাবি ধোপে টিকছে না। আমরা বরং জাতীয় দল নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ফর্মুলার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিই।

জাতীয় দল হিসাবে বিবেচিত হওয়ার ফর্মুলা
১. একটি রাজনৈতিক দলকে পৃথক পৃথক তিনটি রাজ্য মিলিয়ে লোকসভার মোট আসনের ২ শতাংশ আসনে জয়লাভ করতে হবে।
অর্থাৎ, লোকসভার বর্তমান আসন সংখ্যা অনুযায়ী একটি রাজনৈতিক দলকে কমপক্ষে ১১ টি লোকসভা কেন্দ্রে জয়লাভ করতে হবে এবং তা করতে হবে তিনটি পৃথক রাজ্য মিলিয়ে।
২. একটি রাজনৈতিক দলকে চারটি পৃথক পৃথক রাজ্যে লোকসভা বা বিধানসভা ভোটে ৬ শতাংশ করে ভোট পেতে হবে এবং একইসঙ্গে লোকসভার ৪ টি আসনে জয়লাভ করতে হবে।
অর্থাৎ, হয় বিধানসভা ভোটে চারটি পৃথক রাজ্য থেকে একটি রাজনৈতিক দলকে কমপক্ষে ৬ শতাংশ করে ভোট পেতে হবে এবং লোকসভার ৪ টি আসন নিজেদের দখলে আনতে হবে। অথবা লোকসভা নির্বাচনে চারটি পৃথক রাজ্য থেকে একটি রাজনৈতিক দলকে কমপক্ষে ৬ শতাংশ করে ভোট পেতে হবে এবং লোকসভার ৪ টি আসনে জয়লাভ করতে হবে।
৩. একটি রাজনৈতিক দলকে দেশের চারটি পৃথক পৃথক রাজ্যে রাজ্য দলের স্বীকৃতি পেতে হবে।
অর্থাৎ, একটি রাজনৈতিক দলকে চারটি আলাদা আলাদা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোট পেতে হবে এবং সেই রাজ্যগুলির বিধানসভায় নির্দিষ্ট সংখ্যক আসনে জয় লাভের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে রাজ্য দলের স্বীকৃতি আদায় করতে হবে।
ওপরের এই তিনটি শর্তের কোনো একটি শর্ত যদি একটি রাজনৈতিক দল পূরণ করতে সক্ষম হয়, তখন সেই রাজনৈতিক দলটিকে জাতীয় নির্বাচন কমিশন জাতীয় দলের স্বীকৃতি দেয়।
এই শর্তগুলি অনুযায়ী বর্তমানে ভারতের জাতীয় দলের সংখ্যা ৮।
জাতীয় দলের তালিকা
• ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)
• ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (কংগ্রেস)
• বহুজন সমাজবাদী পার্টি (বিএসপি)
• কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট) ( সিপিআই(এম))
• কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই)
• অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস (তৃণমূল)
• ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)
• ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি (এনপিপি)
অর্থাৎ, এই তালিকা দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কংগ্রেস বহাল তবিয়তে তার জাতীয় দলের স্বীকৃতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমরা বরং এই ফাঁকে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রাজ্য দলের নাম দেখে নিই।
উল্লেখযোগ্য রাজ্য দল
* সমাজবাদী পার্টি
* রাষ্ট্রীয় জনতা দল
* শিব সেনা
* শিরোমনি অকালি দল
* আম আদমি পার্টি
* ন্যাশনাল কনফারেন্স
* পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি
* জনতা দল (ইউনাইটেড)
* বিজু জনতা দল
* ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা
* জনতা দল (সেক্যুলার)
* দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম
* অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম
বর্তমানে ৫২ টি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে রাজ্য দলের স্বীকৃতি পেয়েছে।
কোন পথে কংগ্রেস জাতীয় দলের স্বীকৃতি বজায় রাখতে সক্ষম হলো
এই মুহূর্তে কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ শাসনে আছে দেশের চারটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। সেগুলি হল- পাঞ্জাব, রাজস্থান, ছত্রিশগড় ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরি ।
এছাড়াও আরও দুটি রাজ্যে শরিক দলের নেতৃত্বাধীন সরকারে আছে কংগ্রেস। রাজ্য দুটি হল- ঝারখন্ড ও মহারাষ্ট্র ।
এছাড়াও গুজরাট, হরিয়ানা, কেরল, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, অরুণাচল প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখান্ড, পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ অনেকগুলি রাজ্যতে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে শতাব্দী প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটি।
এই হিসাব থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই রাজ্য দলের স্বীকৃতি আছে কংগ্রেসের। সেইসঙ্গে শেষ লোকসভা নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তারা সারা দেশে মোট ৫২ টি আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের ১৯.০১ শতাংশ ভোট পায় কংগ্রেস। এর ফলে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের তিনটি শর্তের একটি পূরণ করলেই যেখানে জাতীয় দলের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব, সেখানে কংগ্রেস নির্বাচন কমিশনের তিনটি শর্তই সম্পূর্ণভাবে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের অন্যতম একটি জাতীয় দল হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয় তারা।

জাতীয় দলের স্বীকৃতি কংগ্রেসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেন?
শতাব্দী প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটিকে যদি আবার ভারতের শাসন ক্ষমতায় ফিরে আসতে হয় তাহলে তাদের জাতীয় দল হিসাবে স্বীকৃতি ধরে রাখাটা খুবই জরুরী। কারণ একবার কোনো ভাবে যদি তাদের জাতীয় দলের স্বীকৃতি চলে যায় তাহলে নেতা কর্মীরা দলের ওপর আস্থা হারাবে। যার ফলস্বরূপ স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেসের স্বাস্থ্য আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। অন্যদিকে বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলি তখন আর কংগ্রেসের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হবে না।
তাই স্বাভাবিকভাবেই নিজের জাতীয় দলের মর্যাদা ধরে রাখতে কংগ্রেস যেমন উদ্যোগী হবে, তেমনি এই মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের আরো শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করবে। একটি জাতীয় দল অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির থেকে বেশ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করে। যেমন-
ক) লোকসভা নির্বাচনের সময় সরকারি সম্প্রচার মাধ্যমে তাদের জন্য নির্দিষ্টসময় বরাদ্দ করা থাকে। ওই বরাদ্দকৃত সময়কে কাজে লাগিয়ে তারা নিজের দলের পক্ষে প্রচার করতে পারে।
খ) জাতীয় দলগুলোর দপ্তর নির্মাণের জন্য নির্বাচন কমিশন দিল্লিতে জায়গা বা আবাসন বরাদ্দ করে।
গ) জাতীয় দলগুলি দেশের সর্বত্র যেকোনো নির্বাচনে নিজেদের নির্দিষ্ট প্রতীক ব্যবহার করার অধিকার লাভ করে। সব সময় একই প্রতীক ব্যবহার করার সুবিধা থাকায় মানুষের মধ্যে জাতীয় দলগুলির পরিচিতি বাড়ানো তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক হয়।
ঘ) নির্বাচন সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায় নির্বাচন কমিশন সর্বপ্রথম জাতীয় দলগুলিকে আহ্বান করে। তার ফলে নিজেদের মতামত রাখার ক্ষেত্রে জাতীয় দলগুলি অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি অপেক্ষা কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করে।
বিহার নির্বাচনে কংগ্রেসের খারাপ ফলের কারণে তাদের জাতীয় দলের স্বীকৃতি বিপন্ন না হলেও তার রাজনৈতিক গুরুত্ব বেশ অনেকটাই। নির্বাচনে কংগ্রেসের এতটা খারাপ ফলের কারণেই মূলত বিরোধী মহাজোট বিহারের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে দেশের বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই বার্তা পৌঁছয় যে কংগ্রেসকে অতিরিক্ত ভরসা করলে তাদেরকেও রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মতো ডুবতে হতে পারে। তার ফলস্বরূপ অনেক আঞ্চলিক দলই হয় বিজেপির বিরুদ্ধে একা লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, না হলে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধলেও তারা কংগ্রেসের ভাগে আসন বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে মূল ক্ষতি কংগ্রেসেরই হচ্ছে। তাদের সাংগঠনিক এবং জনভিত্তির পরিমাণ এর ফলে আরও কমে যেতে পারে।
বিহার নির্বাচনে কংগ্রেসের ওই হতশ্রী ফলাফলের পর ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও বেশ খানিকটা বেকায়দায় পড়েছে কংগ্রেস। বামফ্রন্টের সঙ্গে জোট বেঁধে তারা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বিহার নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাম নেতৃত্ব কংগ্রেসের জন্য বরাদ্দকৃত আসনের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। একই পরিস্থিতির তামিলনাড়ুতে। সেখানেও আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে প্রধান বিরোধী দল ডিএমকে এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের ওপর বিশেষ ভরসা রাখতে না পেরে তাদের বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা কমানোর চেষ্টা করছে। যদিও এই পরিস্থিতি এক মুহুর্তে বদলে যেতে পারে যদি আবার কোনো একটি রাজ্যের নির্বাচনে কংগ্রেস ভালো ফল করে।