নিজস্ব সংবাদদাতা: আজকালকার দিনে বিনা স্বার্থে অক্লান্তভাবে কাজ করে, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় দুষ্কর! তবে এমন মানুষ তো থাকে কোথাও না কোথাও। দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে ঠিক এমন কেউ থাকে, যে সাধারণ মানুষের স্বার্থে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। এমনই একজন বর্ধমানের মাস্টারমশাই সুজিত চট্টোপাধ্যায়।

মাস্টারমশাই

এমনিতে একেবারেই প্রত্যাশাশূন্য, তবে কর্মে অবিচল। কিন্তু তবুও তো মূল্যাঙ্কন হয় আজও। স্কুল শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পর গোটা অবসর জীবনটাই মানুষ তৈরির কাজে ব্যায় করেছেন। এর জন্য পারিশ্রমিক নিয়েছেন বছরে মাত্র দু’টাকা। তাঁর নাম শুনলেই কপালে হাত ঠেকায় বর্ধমানবাসী। এবার সেই সম্মানই জেলা পেরিয়ে ছড়াল জাতীয় স্তরে। পদ্মশ্রী প্রাপক হিসেবে নাম ঘোষণা হল বর্ধমানের এই শিক্ষক সুজিতবাবু। যার পর থেকেই আবেগে ভাসছে সুজিতবাবুর পরিবার।

IMG 20210127 130009

সরকারি হিসেবে অবসর নিয়েছেন প্রায় পনোরো বছর আগে। বয়স এখন ৭৬। তবে মনের বয়স অনেক কম। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত টানা টিউশন পড়ানো তাঁর নেশা সুজিতবাবুর। নিজের একটা নাম দিয়েছেন তিনি, সদাই ফকির। সেই সদাই ফকিরের পাঠশালায় বর্তমানে পড়ুয়ার সংখ্যা তিনশোরও বেশি। তবে এই বাজারেও টিউশন ফি বছরে দু টাকা। তাও দিতে হবে পাঠগ্রহণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর।

সুজিতবাবুর কথায়, এইটুকুই গুরুদক্ষিণা। যা না নিলে শিক্ষাদান সম্পূর্ন হয় না। সদাই ফকিরের গুরুকুলের নিয়ম দু’টাকা গুরুদক্ষিণা দিয়ে শিক্ষাগুরুকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে পরীক্ষা দিতে যাবেন পড়ুয়ারা। তবে সে নিয়মও মানতে পারে না অনেকেই। তবু ছ’মাস পর হলেও ঠিক মনে করে গুরুদক্ষিণা দিয়ে যায় অনেকে।

“লিখে রেখো একফোঁটা দিলেম শিশির”- এটিই আপ্তবাক্য সদাই ফকিরের। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সারাবছর পড়িয়ে জ্ঞানসমুদ্রের এক কনা শিশিরটুকুই তিনি দিতে পারেন পড়ুয়াদের। শুধু পাঠদান নয়, শিক্ষা দেন স্বভাব, চরিত্রগঠনেরও। পদে পদে মনে করিয়ে দেন সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা। সহায় সম্বলহীনদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পড়ুয়াদের উৎসাহিত করেন।

পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম জঙ্গলের মাঝে বীরভূম জেলা লাগোয়া উত্তর রামনগর গ্রাম। সেখানেই বাস এই প্রবীন শিক্ষকের। তাঁর মা আলোকলতার নামে পাঠশালার নাম ‘আলোকতীর্থ’। সবুজে ঘেরা শান্ত নিরিবিলি উঠানের শেষে টিনের চালের দেড়তলা মাটির বাড়ি। বাড়ির সামনে বাঁধানো কুয়ো, ধানের পালুই। সেই মাটির বাড়ির নিচের বারান্দায়, কখনও রোদ পিঠে নিয়ে পাঠশালা বসে সকালে। চলে সন্ধে পর্যন্ত। সুজিত বাবুর শিক্ষকতা শুরু হয় রামনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে। চল্লিশ বছর চাকরির পর ২০০৪ সালে অবসর নেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ভীষণই ঘনিষ্ঠ এই শিক্ষক।