জয়া বচ্চন বলিউডে একের পর এক অসামান্য অভিনয় করে গিয়েছেন। প্রবাসী বাঙালি হিসেবে বাংলাতেও তিনি বেশ কিছু কাজ করেছেন। তবে ধন্যি মেয়ে সিনেমায় তার চরিত্রটি বাংলায় বোধহয় তার করা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র। যদিও এই মুহূর্তে অভিনয় নয়, বাংলার রাজনীতিতে তিনি তৃণমূলের কাছে ধন্যি মেয়ে হয়ে উঠতে পারবেন কিনা তা নিয়েই সবচেয়ে বেশি চর্চায় আছেন। রাজ্যে ভোট প্রচারে এসে বলে দিয়েছেন স্বৈরতান্ত্রিক বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্থাৎ পিচ প্রস্তুত করেই ফেলেছেন, এবার ব্যাটিংয়ের ওপর বাকিটা। যদিও বোলিংয়ের ভূমিকা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না!

মিঠুন চক্রবর্তী আবার মৃণাল সেনের হাত ধরে উঠে আসলেও একসময় বলিউড দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। বলতে গেলে জয়া বচ্চন যার ঘরণী সেই অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে একসময় কড়া টক্কর দিয়েছেন মিঠুন। কখনও কখনও তাকে ছাপিয়ে গিয়েছেন তিনি। বাংলার রাজনীতিতে অবশ্য গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী ওরফে মিঠুনের উপস্থিতি নতুন নয়। তবে তিনি বারবার শিবির বলেছেন এমনটাই অভিযোগ একাংশের। এবারের নির্বাচনে তিনি জয়া বচ্চনের ঠিক উল্টো ভূমিকায়। বিজেপির গেরুয়া পতাকা ওড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে ভোট ময়দানে একরকম ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ‘ফাটা কেষ্ট’।

ভারতের নাগরিক হিসেবে জয়া বচ্চন-মিঠুন ভোটের প্রচারে অংশগ্রহণ করতে পারে,ন প্রার্থী হতেও পারেন। তাতে কারোর কিছু বলার নেই। কিন্তু তারা তারকা প্রচারক হিসেবে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তা নির্বাচনী ময়দানে কতটা প্রভাব ফেলবে সেটাই আমাদের দেখার। এই বাংলায় রঙিন পর্দার তারকারা কিন্তু এর আগেও বারেবারে ভোট প্রচারে এসেছেন। সব মিলিয়ে আমরা একটু বিশ্লেষণ করে দেখব এবারের ভোটে জয় বচ্চন ও মিঠুনের উপস্থিতি কতটা প্রভাব ফেলছে।


[  ] ভোটার অনেক সচেতন-

বাংলার ভোটে আজও রঙিন পর্দার তারকাদের দেখতে সাধারণ মানুষ ভিড় জমান। তা বলে তারা যে সবাই সেই তারকাকেই বা তার দলকে ভোট দেবেন এরকম কোনও কথা নেই। গত কয়েকটি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে বাংলার মানুষ বর্তমানে অনেক সচেতন হয়ে ভোট দেন। কেবলমাত্র তারকা’র ঝলকানি দিয়ে যে তাদের সমর্থন আদায় করা যাবে না তা আজ পরিষ্কার। না হলে বাঁকুড়া থেকে মুনমুন সেন হেরে যেতেন না‌। এই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন রূপা গাঙ্গুলী, সোহম চক্রবর্তীর মতো তারকারা। তারা নির্বাচনে লড়াই করেছেন এবং পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।


[  ] তারকা দুর্বল সংগঠনের খামতি ঢেকে দেয়-

মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন নির্বাচনী লড়াই কিছুটা হলেও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ‌ও বটে। যে সমস্ত জায়গায় কোন‌ও রাজনৈতিক দল দুর্বল হয়ে থাকে সেখানে জনপ্রিয় তারকারা ভোট প্রচারে গেলে যথেষ্ট ভিড় হয়। সেই ভিড়কে সামনে তুলে ধরে নিচু তলার কর্মীদের চাঙ্গা করে তুলতে পারে রাজনৈতিক দলগুলি। তাই ভোট ময়দানে তারকাদের উপস্থিতির একেবারে কোনও গুরুত্ব নেই তা নয়। বিশেষ করে মিঠুন চক্রবর্তীর মতো তারকা আজও গ্রামবাংলায় সমান জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয়তার সঙ্গে একমাত্র টেক্কা নিতে পারেন প্রসেনজিৎ, জিৎ এবং দেব। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপির সংগঠন রাজ্যের সর্বত্র শক্তিশালী নয়। তাদের সেই খামতি অনেকটাই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মিঠুন চক্রবর্তীকে ঘিরে।


[  ] জনপ্রিয় ফিল্মি ডায়লগকে হাতিয়ার করে আলোচনায় থেকে যাওয়া যায়-

নির্বাচনী রাজনীতির আরেকটি দিক হল প্রতিমুহূর্তে ভোটারদের মনে উপস্থিত থাকা। এটা রুপোলি পর্দার তারকাদের সাহায্যে করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। যেমন ৭ মার্চ বিজেপির ব্রিগেড সমাবেশে দলে যোগ দিয়েই বক্তব্য রাখার সময় মিঠুন চক্রবর্তী তাঁর সেই বিখ্যাত সংলাপ আওরেছিলেন ‘ আমি বালি বোড়াও ন‌ই, জলঢোঁড়াও ন‌ই, আমি জাত গোক্ষরো। এক ছোবলে ছবি।’ তারপর থেকেই বেশ কিছুদিন রাজ্যের সাধারণ মানুষ মিঠুনের কথা নিয়ে চর্চা করেছেন। কেউ পক্ষে ছিলেন, কেউবা বিপক্ষে। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার মিঠুনের হাত ধরে ভোটারদের আলোচনায় প্রতিমুহূর্তে ছিল বিজেপি। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দলগুলির এটা অন্যতম লক্ষ্য হয়।

[  ]  প্রার্থী যদি তারকা হয়, কখনও কখনও সুবিধে হয়-

প্রার্থী সুপারস্টার হলে তার ডিভিডেন্ড যে ভোট ময়দানে অনেক সময় পাওয়া যায় তা পরিষ্কার। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হবেন দেব। উনিশ এর লোকসভা ভোটে পশ্চিম মেদিনীপুরে ভালোমতোই প্রভাব বিস্তার করেছিল বিজেপি। কিন্তু ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন টলিউড তারকা দেব। অনেকেই মনে করেন তার জন্যই ওই কেন্দ্রটি নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। কিন্তু এবারের ভোটে মিঠুন চক্রবর্তী বিজেপির হয়ে প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়লেও তিনি প্রার্থী হননি। তাই দেবের ক্ষেত্রে যে সুবিধা তৃণমূল পেয়েছিল, মিঠুনের ক্ষেত্রে সেই সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম।


[  ]  তারকাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ খোঁজে না মানুষ-

গ্রামবাংলার মানুষের একাংশ আজও রুপালি পর্দার তারকাদের দেখলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। তারা অনেকেই রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ভুলে পছন্দের তারকাকে ভোট দেওয়ার জন্য এগিয়ে যান। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই তারকা যত বেশি তার অভিনীত চরিত্রের কথাগুলি আওড়াবেন বা নিজের গাওয়া গান গাইবেন তত মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন।কিন্তু সেই তারকা যদি অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন হন এবং তিনি ক্রমাগতই রাজনীতির কথা বলেন তাহলে সাধারন মানুষকে সেই বিষয়টি খুব একটা ছোঁয় না। সে কারণেই বোধহয় জয়া বচ্চনের উপস্থিতির ডিভিডেন্ড খুব একটা তৃণমূল পাবে না। কারণ একদিনের জন্য হলেও বাংলার ভোট প্রচারে এসে এই তারকা সাংসদ কোন‌ও ফিল্মি ডায়লগ নয়, বরং হার্ডকোর রাজনীতির কথা বলেছেন। মনে হয় না সাধারণ মানুষের কাছে তা খুব একটা আকর্ষণীয় হবে বলে।


[  ]  ভোট ময়দানে রক্ত গরম করা তারকা চাই, বোদ্ধা নয়-

ভোটের ময়দানে মিঠুন চক্রবর্তী, দেব, চিরঞ্জিত’রাই জনপ্রিয় হন। তাদের রক্ত গরম করা কথাকে হাতিয়ার করে আসলে মানুষ কোথাও গিয়ে এই তারকা রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাদের চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোকে খুঁজে বেড়ান। কিন্তু জয়া বচ্চনের মত যদি সঠিক কথা পরিশীলিত ভঙ্গিতে উত্থাপন করা হয়, তা বোধহয় খুব একটা নাড়া দেয় না ভোটারদেরকে। অতীতের ঘটনা তাই প্রমাণ করে দিচ্ছে।



[  ]  তারকাদের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে-

ব্যতিক্রম কিছু থাকতে পারে কিন্তু বাস্তব হল বাংলার তারকাদের একের পর এক দলবদল এবং নিজেদের বিতর্কিত অবস্থান নেওয়ার কারণে সার্বিকভাবে তারকাদের সম্বন্ধে মোহভঙ্গ হয়েছে সাধারণ মানুষের। তাই প্রচারে ভিড় হলেও মিঠুন চক্রবর্তী, জয়া বচ্চনদের দেখে বাংলার সাধারণ মানুষ তাদের দলকে ঢেলে ঢেলে ভোট দেবেন এরকম আশা না করাই ভালো। যে মিঠুন একসময় বাংলার প্রতিটি মানুষের অত্যন্ত প্রাণের ছিলেন তার বারবার রাজনৈতিক অবস্থান বদলের কারণে একাংশের কাছে তিনি চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন। সর্বোপরি বাংলার এবারের ভোটযুদ্ধ অনেক বেশি রাজনৈতিক হচ্ছে। তাই তারকার চমক সৃষ্টি করে এবারে বাজিমাত করতে পারার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।