২২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাজ্যের ছয় নম্বর দফার নির্বাচন। ভোট যখন শুরু হবে তার আগেই নির্বাচন কমিশন সরকারিভাবে জানিয়ে দিয়েছে পুরানো নির্ঘণ্ট মেনেই ভোট হবে। অর্থাৎ আট দফাতেই পশ্চিমবঙ্গের ভোট পর্ব সম্পূর্ণ হতে চলেছে। এরইমধ্যে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ প্রবল টানাটানি শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মনে প্রবল উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ক্রমবর্ধমান করোনা সংক্রমণকে ঘিরে। সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক আবার লকডাউন হবে নাতো?

করোনা সংক্রমণকে সামনে রেখে কোন রাজনৈতিক দল কি ভাবে শেষ দিনটি দফার নির্বাচনে প্রচার পর্ব সম্পন্ন করল তা এই মুহূর্তে ভোটারদের একাংশের কাছে বিচার্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এই মহামারী ভয়াবহ রূপ ধারণ করার পর রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের নির্বুদ্ধিতা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সবমিলিয়ে ষষ্ঠ দফার ভোট বেশ জমজমাট। কিন্তু আমরা আজ এই দফার ছ’জন তারকা প্রার্থীর দিকে চোখ রাখব।


১) রাজ চক্রবর্তী-

টলিউড পরিচালক রাজ চক্রবর্তীকে চেনেন না এরকম মানুষ পশ্চিমবঙ্গে সত্যিই বিরল। একের পর এক সুপারহিট কমার্শিয়াল সিনেমা তৈরি করার ফলে তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। বরাবরই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রাজ। এবারের বিধানসভা ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে যোগ দেন। হাতে গরম ফল হিসেবে ব্যারাকপুর বিধানসভা কেন্দ্রের টিকিট পেয়েছেন।

উত্তর চব্বিশ পরগনার ব্যারাকপুর মহকুমার সদর শহর ব্যারাকপুরকে নিয়ে এই বিধানসভা কেন্দ্রটি গঠিত। গত লোকসভা নির্বাচনের পর ব্যারাকপুরের যে রাজনৈতিক সমীকরণ দাঁড়িয়েছে তাতে দলীয় কোন‌ও নেতার উপর ভরসা না করে এই সেলিব্রিটি মুখকে প্রার্থী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসলে চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত ইমেজের উপর ভর করে বাজি মারতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। রাজ জিততে পারবেন কিনা তা পরের কথা, কিন্তু তিনি নির্বাচনী ময়দানে নেমে সাধারণ মানুষের মনে যে ভাবে জায়গা করে নিয়েছেন তা অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা। তবে অর্জুন সিং এর ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ব্যারাকপুরে সত্যিই রাজ চক্রবর্তীর লড়াইটা অনেকটা কঠিন। আসলে এই ভোটের ময়দান যে সেলুলয়েডের কল্পিত দুনিয়া নয় তা দ্রুত বুঝে গিয়েছেন এই সেলিব্রেটি প্রার্থী।


২) কৌশানি মুখোপাধ্যায়-

তরুণ প্রজন্মের ছেলেদের অন্যতম হার্ট থ্রব অভিনেত্রী কৌশানি। তিনি যে কোনও দলের হয়ে ভোটে দাঁড়াবেন তা সত্যিই ভাবা যায়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই তৃণমূলে যোগ দেন এই তারকা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী করেন। বলা যেতে পারে হারা আসন পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছেন এই তরুণ প্রজন্মের সেলিব্রেটিকে।

তবে কৌশানি মুখোপাধ্যায়ের প্রার্থী হওয়ার ঘটনার সঙ্গে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য জড়িয়ে আছে। তার প্রেমিক বনি সেনগুপ্ত এবারের নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই বিজেপিতে যোগ দেন। সত্যিই অদ্ভুত ঘটনা! তবে কৌশানি মাটি কামড়ে পড়ে থেকে লড়াই চালাচ্ছেন কৃষ্ণনগর উত্তরে। তবে তার লড়াইটা বড্ড কঠিন। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যে কটা আসন চোখ বুঝে জিতবে বলে মনে করে তার মধ্যে একটা এই কৃষ্ণনগর উত্তর।


৩) মুকুল রায়-

বাংলার রাজনীতিতে মুকুল রায়ের রাজনৈতিক ওজন নিয়ে কারোর মনে কোনও সংশয় নেই। বলতে গেলে তিনি বাংলার রাজনীতিতে কিংমেকার হিসেবে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেছেন। সাধারণত সরাসরি জনগণের দরবারে হাজির না হয়ে নির্বাচন পরিচালনা করার মধ্য দিয়েই বারবার নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে এসেছেন এই রাজনীতিবিদ। তবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপে শেষ পর্যন্ত তাকে জনতা জনার্দনের দরবারে হাজির হতে হয়েছে।

মুকুল রায়কে বিজেপি অবশ্য তাদের একদম নিরাপদ একটি কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে। কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে মুকুল রায়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলের কৌশানি মুখোপাধ্যায়। যদিও এই টলিউড তারকাকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না মুকুল। বলতে গেলে সেভাবে ভোট প্রচারেও তিনি বেরহননি। এই কেন্দ্রের হাওয়া বিজেপির দিকে এতটাই প্রবল যে তিনি ঘরে বসেই জিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন!


৪) রাহুল সিনহা-

নিন্দুকেরা বলে থাকেন রাহুল সিনহা আসলে খাতায়-কলমে হেভিওয়েট রাজনীতিবিদ। অবশ্য তার নির্বাচনী লড়াইয়ে ট্র্যাক রেকর্ড এতটাই করুন যে এই কথাটা খুব একটা অতুক্তি হবে না। তবুও বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি হিসেবে তার রাজনৈতিক গুরুত্ব একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তাকে উত্তর চব্বিশ পরগনার হাবরা কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে গেরুয়া শিবির।

এবারের নির্বাচনী লড়াই রাহুল সিনহার কাছে আসলে রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। কারণ বিজেপির অভ্যন্তরে তার অবস্থান খুব একটা পাকাপোক্ত নয়। এই পরিস্থিতিতে তিনি যদি আবারও হেরে যান তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যেতে পারে। এমনিতে যথেষ্ট ভালো আসনে তাকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের থেকে ২০ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিল তারা। এখন দেখার অনুকূল পরিবেশে রাহুল বাবু নিজের ভাগ্য বদলাতে পারেন কিনা।


৫) ইমরান আলি রামজ (ভিক্টর)-

বামফ্রন্টের মেজ শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক। কিন্তু তাদেরই এক তরুণ বিধায়ক রাজ্য রাজনীতির অন্যতম তারকা হিসেবে অবস্থান করছেন গত দশ বছর ধরে। সেই তরুণকেই আবারও উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়া কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে ফরওয়ার্ড ব্লক।

তরুণ ইমরান আলি রামজ বিধানসভার ভেতরে এবং বাইরে তার দাপট বারবার দেখিয়েছেন। যদিও রাজ্য রাজনীতিতে তিনি ভিক্টর নামে পরিচিত। চাকুলিয়ায় তিনি নিজের রাজনৈতিক সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন। তাই সম্ভবত তাকে হারাতে একই দিনে চাকুলিয়ায় সভা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অমিত শাহ। যদিও এই তরুণ প্রার্থী নিজের জয়ের বিষয়ে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত।


৬) চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য-

তৃণমূল নেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলিয়ে ক‌ইয়ে হিসেবে যথেষ্ট সুপরিচিত। পেশায় আইনজীবী এই প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম স্নেহভাজন। তিনি বেশ ভালো গান করেন। কিন্তু ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি হেরে যান উত্তর চব্বিশ পরগনার দমদম উত্তর কেন্দ্রে। এবার তাকে ওই দমদম উত্তর কেন্দ্রেই প্রার্থী করেছে তৃণমূল।

চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জিতবেন কিনা সেটা ভোট গণনার দিন পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে তার দাপট এবং ওজন সম্বন্ধে রাজ্যবাসী ওয়াকিবহাল। তৃণমূলের মহিলা শাখার সভানেত্রী হিসেবে তিনি বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। একের পর এক আন্দোলনে তাকে সামনে রেখে লড়াই করেছে তৃণমূল। স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে নজর আছে রাজ্যের মানুষের।