পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে দলবদলের সংস্কৃতি আগে খুব একটা প্রচলিত ছিল না। ২০১১ এর বিধানসভা নির্বাচনে জয় লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর দলবদল সংস্কৃতির রমরমা শুরু হয়। অনেকের তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের হাত ধরে এই সংস্কৃতির আমদানি ঘটেছিল রাজ্যে। পরবর্তীতে চাকা উল্টেয়ে গিয়ে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়ার ঢল নামে।

এই মুহূর্তে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগদানের সম্ভাবনা ঘিরে রাজ্য রাজনীতি সরগরম হয়ে আছে। আসুন আমরা দেখেনিই ইতিমধ্যেই কোন দশজন হেভিওয়েট নেতা তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন এবং দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করছেন।

১) মুকুল রায়

তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া নেতাদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড় নাম মুকুল রায়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সাংগঠনিক দক্ষতার ফলেই মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন বলে মনে করা হয়। বিরোধী কংগ্রেস ও সিপিআই(এম) এর হাত থেকে একের পর এক পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচন ছাড়াই তৃণমূলের দখলে নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। রাজ্য রাজনীতিতে “চাণক্য” বলে পরিচিত মুকুল রায় বর্তমানে বিজেপির অন্যতম সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। তার হাত ধরেই তৃণমূল থেকে অনেক হেভিওয়েট নেতা পরবর্তীতে বিজেপিতে যোগদান করে। এই রাজ্যে বিধানসভা ভোটের কৌশল নির্ধারণের যাবতীয় ক্ষমতা তাকেই দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ’রা।

২) শোভন চ্যাটার্জি

মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা প্রিয় “কানন” শোভন চ্যাটার্জি একাধারে ছিলেন তৃণমূলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি, কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র এবং রাজ্যের মন্ত্রী। এর থেকেই বোঝা যায় তাকে কতটা ভরসা করতেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সমস্যা শুরু হলে ক্রমশ দলের বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন। কিছুদিন পরেই মন্ত্রিত্ব এবং মেয়র পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। যদিও বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর দলের রাজ্যের নেতৃত্বের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতান্তর ঘটায় তিনি এখনো পর্যন্ত নতুন দলে সক্রিয় হননি। এই মুহূর্তে বিজেপির রাজ্য কমিটির অন্যতম আমন্ত্রিত সদস্য তিনি।

৩) সব্যসাচী দত্ত

রাজারহাটের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত একই সঙ্গে বিধাননগর পৌরনিগমের মেয়র ছিলেন। দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় মুকুল রায় ঘনিষ্ঠ এই নেতা পরবর্তীতে বিজেপিতে যোগদান করেন। তিনি বর্তমানে বিজেপির অন্যতম রাজ্য সম্পাদক।

৪) অর্জুন সিং

রাজ্য রাজনীতিতে “বাহুবলী” নেতা নামে খ্যাত অর্জুন সিং ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের ঠিক আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেন। তার আগে তৃণমূলে থাকাকালীন তিনি একসঙ্গে ভাটপাড়ার বিধায়ক ও ভাটপাড়া পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। লোকসভা নির্বাচনের সময় অর্জুন সিং তৃণমূলের টিকিটে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু দল তাকে টিকিট না দিয়ে আগেরবারের জয়ী প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদীকে প্রার্থী হিসাবে মনোনীত করলে দল ছাড়েন অর্জুন। বিজেপির টিকিটে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে থেকে লড়াই করে তিনি তৃণমূল প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদীকে হারিয়ে দেন। এর ফলে দলের অভ্যন্তরে তার গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। তিনি বর্তমানে বিজেপির অন্যতম রাজ্য সহ-সভাপতি।

৫) সৌমিত্র খাঁ

এই আধুনা বিজেপি নেতার দলবদলের ইতিহাস বেশ জমজমাট। তিনি ২০১১ এর বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের বিধায়ক নির্বাচিত হন। যদিও কিছুদিন পরেই তৃণমূলে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তৃণমূলের টিকিটে তিনি বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর কেন্দ্র থেকে লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হন। কিছুদিনের জন্য যুব তৃনমূলের সভাপতিও ছিলেন তিনি। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেন এবং বিজেপি প্রার্থী হিসাবে বিষ্ণুপুর কেন্দ্র থেকে পুনরায় নির্বাচিত হন। সৌমিত্র খাঁ বর্তমানে বিজেপির যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতির দায়িত্বে আছেন।

৬) লকেট চট্টোপাধ্যায়

তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জির গুডবুকে থাকা টলিউড অভিনেত্রীদের অন্যতম ছিলেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী তাকে রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য করেন। লকেট মহিলা কমিশনের সদস্য হিসাবে প্রথম থেকেই বেশ সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তীতে কিছু আভ্যন্তরীণ কারণে তার সঙ্গে দলের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এর কিছুদিন পর তিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেন। এক সময় তাকে বিজেপির মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে হুগলি কেন্দ্র থেকে তিনি বিজেপি প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে দু’বারের তৃণমূল সাংসদ রত্না দে নাগকে পরাজিত করে জয়ী হন। তিনি বর্তমানে বিজেপির অন্যতম রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।

৭) নিশীথ প্রামানিক

নিশীথ প্রামানিক তৃণমূলে থাকাকালীন কোচবিহার জেলার যুব তৃণমূল সভাপতি ছিলেন। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে যুক্ত থাকার অভিযোগে দল তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিলে তিনি বিজেপিতে যোগদান করেন। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে কোচবিহার কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। তিনি বর্তমানে বিজেপির যুব মোর্চার অন্যতম রাজ্য নেতা।

৮) অনুপম হাজরা

বিতর্কিত এই অধ্যাপক ২০১৪ এর লোকসভা ভোটে বীরভুমের বোলপুর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে জয়লাভ করে সাংসদ হন। পরবর্তী পর্যায়ে বীরভূম জেলার তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে মতবিরোধ বাধলে দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেন। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে শহরতলীর যাদবপুর কেন্দ্রে তাকে প্রার্থী করে বিজেপি। যদিও তৃণমূলের তারকা প্রার্থী মিমি চক্রবর্তীর কাছে পরাজিত হন তিনি। বর্তমানে তাকে সর্বভারতীয় সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে বিজেপি।

৯) শঙ্কুদেব পণ্ডা

তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি হিসাবে সমস্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন একসময়। দল তাকে ছাত্র পরিষদের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দিলে এই দাপুটে নেতা আড়ালে চলে যান। পরবর্তীতে মুকুল রায়ের হাত ধরে বিজেপিতে যোগদান করেন। শঙ্কুদেব পণ্ডা বর্তমানে বিজেপির যুব মোর্চার রাজ্য সহ-সভাপতি পদে আছেন।

১০) মিহির গোস্বামী

কোচবিহার দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের এই তৃণমূল বিধায়ক অতিসম্প্রতি দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেন। তার বিজেপিতে যোগদানের ফলে কোচবিহার জেলায় বিজেপি আরো শক্তিশালী হলো বলে মনে করা হচ্ছে।

এরা ছাড়াও সুনীল সিং, শুভ্রাংশু রায়, বিশ্বনাথ পারিয়ালের মত আরো বেশকিছু বিধায়ক তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি শিবিরে ইতিমধ্যেই নাম লিখিয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে আগামী দিনে এই তালিকা হয়তো আরো দীর্ঘ হবে।