চতুর্থ দফার ভোট হয়েছিল ১০ এপ্রিল। তারপর ১৭ এপ্রিল পঞ্চম দফার নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে। এই মাঝের সময়টাতেই সারা দেশের পাশাপাশি বাংলাতে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। বলা ভালো বিপদসীমার উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে এই মহামারীর ঢেউ। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যবাসীর একটা বড়ো অংশ নির্বাচন স্থগিত রাখার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তাদের পরিষ্কার বক্তব্য ছিল মানুষের জীবন আগে। যেহেতু ভোট প্রচারের সভা ও রোড শো গুলিতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করছে তাই সর্বত্র করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। বাস্তবে হচ্ছেও বটে তা। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন করোনাভাইরাসের গোষ্ঠী সংক্রমণ ঘটতে শুরু করেছে।

জল্পনা শুরু হয়েছিল নির্বাচন কমিশন শেষ চার দফার ভোটে বেশকিছু আদল-বদল আনতে পারে। মনে করা হচ্ছিল শেষ চার দফার ভোটের সময় কমিয়ে দু’দফায় গোটাটা সেরে ফেলতে পারে কমিশন। আবার এরকম শোনা যাচ্ছিল ভোট চার দফাতে হলেও নির্বাচনী প্রচারে লাগাম টেনে ধরবে দিল্লির নির্বাচন ভবন। ছোটো ছোটো পথসভা ছাড়া ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রচার করতে বলবে কমিশন। অবশ্য যাবতীয় জল্পনা শেষ পর্যন্ত অশ্বডিম্বে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করার পর জানিয়ে দিয়েছে বাকি চার দফার ভোট আগের মতই সূচি মেনে অনুষ্ঠিত হবে। তারা এও জানিয়েছে আগে যেমন নির্বাচনী প্রচার কাজ চলছিল সেরকমই চালাতে পারবে রাজনৈতিক দলগুলি। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের এই ঘোষণা পরিস্কার করে দিল কোনভাবেই হাজার হাজার মানুষের জমায়েত এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। আমরা এই পরিস্থিতির উপরে দাঁড়িয়ে বাকি চার দফার ভোটে করোনা পরিস্থিতির এই ভয়াবহ রূপ কি কি প্রভাব ফেলতে পারে সেটাই খুঁজে দেখব।


১) ভোটদানের হার কমে যেতে পারে-

বাংলার ভোটে চিরাচরিত রীতি হল উচ্চ হারে ভোটদান। এবারেও প্রথম চার দফার ভোটে প্রতিটি দফাতেই ৮০ শতাংশের উপর মানুষ ভোট দিয়েছেন। কিন্তু করোনার এই বাড়াবাড়ির ফলে আতঙ্কিত রাজ্যবাসীর একাংশ বুথ মুখী নাও হতে পারেন। কারণ এই মহামারীর প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ভোটদান বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন অনেকে। সে ক্ষেত্রে ভোটদানের হার অনেকটাই কমে যাওয়া সম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের মানুষ যদি এই পথে হাঁটে তবে প্রতিটা রাজনৈতিক দলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


২) নির্বাচন পরিচালনার কাজে কর্মী সঙ্কট ঘটতে পারে-

করোনা সংক্রমণ যেভাবে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ভোট পরিচালনার কাজে যে সমস্ত সরকারি আধিকারিকদের নিযুক্ত করা হয়েছে তাদের একটা বড়ো অংশ এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। সেক্ষেত্রে কর্মী সঙ্কটের কারণে ভোট পর্ব পরিচালনা করাই দুষ্কর হয়ে উঠবে নির্বাচন কমিশনের। আবার যাবতীয় নিয়মবিধি থাকলেও করোনা পরিস্থিতির লাগামছাড়া বাড়বাড়ন্তের কারণে সরকারি কর্মীদের একাংশ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দায়িত্ব পালন করতেও বেঁকে বসতে পারেন। সেক্ষেত্রেও ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়বে নির্বাচন কমিশন।


৩) একাধিক কেন্দ্রের নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা-

নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী নির্বাচন পর্ব চলাকালীন কোন‌ও কেন্দ্রের প্রার্থী মারা গেলে সেখানকার ভোট পর্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেওয়া হয়। কয়েকদিন পর আবার সেই কেন্দ্রের নতুন করে মনোনয়নপত্র দাখিলের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে সেখানকার ভোট গ্রহণ করে নির্বাচন কমিশন। ইতিমধ্যেই মুর্শিদাবাদ জেলার সামশেরগঞ্জ এবং জঙ্গিপুর কেন্দ্রের প্রার্থীরা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। আরও বেশ কয়েকজন ভোট প্রার্থী ইতিমধ্যেই করোনা আক্রান্ত। স্বাভাবিকভাবেই করোনার সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তাতে প্রার্থীদের মৃত্যুজনিত কারণে বেশকিছু কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না নির্বাচন কমিশনের।


৪) সাধারণ মানুষের কাছে রাজনৈতিক দলগুলির ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়া-

করোনার প্রাদুর্ভাব সত্বেও ভোট প্রক্রিয়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের উপর ব্যাপক ক্ষুব্ধ। এই পরিস্থিতিতে ভোট প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা যদি আরও বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায় তবে সার্বিকভাবে বর্তমান রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরী হতে পারে। যা রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি দেশের বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে মোটেও শুভসংকেত নয়। রাজনৈতিক দলগুলি এর ফলে সাধারণ মানুষের যেমন আস্থা হারাবে তেমনি নির্বাচন কমিশন সম্বন্ধে মানুষের মনে এখনও পর্যন্ত যেটুকু আস্থা আছে তাও উঠে যাবে। তার ফলে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয় সমগ্র ভারতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সঠিকভাবে সম্পন্ন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠবে।


৫) কমিশন কঠোর হলে রাজনৈতিক দলগুলির খরচ ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে-

করোনা পরিস্থিতিতে কিভাবে ভোট পর্ব পরিচালনা করা হবে তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন অনেক আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন জারি করেছে। কিন্তু বাংলার ভোটে দেখা যাচ্ছে ভোটগ্রহণের দিন বুথগুলিতে করোনা বিধি মেনে চলা হলেও রাজনৈতিক দলগুলি যখন প্রচার চালাচ্ছে সেই সময় কোন‌ও নিয়ম-কানুন মানা হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে তারা রাজনৈতিক দলগুলিকে করোনা বিধি মানতে বাধ্য করতে পারছে না। এদিকে নতুন নির্দেশিকা জারি করে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এবার থেকে কঠোরভাবে যাবতীয় করোনা বিধি মেনে চলতে হবে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির খরচ অনেকটাই বাড়বে। কারণ মাস্ক-স্যানিটাইজার সহ যে সমস্ত করতে হবে তার খরচ খুব একটা কম নয়। এই খরচ বৃদ্ধির ফলে বড়ো রাজনৈতিক দলগুলি ততটাও সমস্যার সম্মুখীন না হলেও ছোটো ছোটো রাজনৈতিক দল বাধ্য হতে পারে প্রচার পর্ব বন্ধ করে দিতে। যা আখেরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকারক।