মুলুটি
সৌজন্যে নিজস্ব তোলা আলোকচিত্র

মুলুটি -ঝাড়খন্ড রাজ্যের দুমকা জেলার শিকারীপাড়া থানার অন্তর্গত ঐতিহ্যময়, ঐতিহাসিক এই গ্রামটির কথা ইতিহাস মনে রাখেনি । তাই অনাদরেই পরে আছে রাজা বাজ বসন্তের কীর্তি । কলকাতা থেকে বীরভূমের রামপুরহাঠ হয়ে গাড়ি নিয়ে এক দিনে ঘুরে আসা যায় মুলুটি থেকে । শান্তিনিকেতন, তারাপীঠ, বিষ্ণুপুর, দীঘা মন্দারমনী তো রয়েইছে, এইসব জায়গা ছারা একটু নিরিবিলিতে চলুন না ঘুরে আসা যাক ! ভাবছেন কি কি দেখবেন এখানে ? ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামটি সমন্ধে বিস্তারিত জানতে অবশ্যই পড়ুন আজকের প্রচ্ছদটি ।

IMG 20201124 233511 1
সৌজন্যে নিজস্ব তোলা আলোকচিত্র: অবহেলায় পরে আছে বাজ বসন্তের তৈরী টেরেকোটা মন্দির

ঐতিহাসিক আখ্যান:

বেশীরভাগ পর্যটকেরাই রামপুরহাঠের তারাপীঠ দর্শনে আসেন কিন্তু এই রামপুরহাঠ থেকে 16 কিলোমিটার দূরেই যে মৌলাক্ষী মায়ের মন্দির এবং টেরাকোটা র ভাস্কর্যে সজ্জিত একটি ছোটো ঐতিহ্যময় গ্রাম আছে সেটা অনেক পর্যটকরই অজানা । তবে এই অজানা গ্রামের কথা সর্বোসমক্ষে তুলে ধরতেই আজকের এই প্রচ্ছদ ।

ঐতিহাসিক তথ্যনানুযায়ী পঞ্চদশ শতকের নানকর রাজ কর মুক্ত সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন এবং সেই সময় এই মুলুটি গ্রামই ছিল তার রাজধানী । এই গ্রামে প্রথম রাজত্ব স্থাপন করেন রাজা বাজ বসন্ত । এইখানে উল্লেখ্য রাজা বাজ বসন্ত কিন্তু কোনো রাজ পরিবারের সন্তান ছিলেন না, তিনি জন্ম নেন গরীব একজন ব্রাহ্মণের ঘরে । এই ব্রাহ্মণপুত্র কিভাবে রাজা বাজ বসন্ত হয়ে উঠল তার একটি রোমাঞ্চকর কাহিনীর সাক্ষর বহন করে ইতিহাস । কথিত আছে কোনো এক সময় গৌড় সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এই গ্রামে বেড়াতে আসেন, সাথে ছিল সুলতানের প্রিয় পোষ্য একটি বাজ পাখি । কোনো কারনবশত সেই পাখিটি তার বাধন ছেরে উড়ে যায় এবং তখনই বসন্ত কোনো প্রকারে সেই বাজ পাখিটি সুলতান কে ফিরিয়ে দেন ।

কৃতজ্ঞতা স্বরূপ গৌড় সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ গ্রামটি উপহার দেন বসন্ত কে । এই কাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের পাতায় বসন্ত, রাজা বাজ বসন্ত নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে । ক্রমে কাশীর সুমেরু মঠের দন্ডি সন্যাসী র সাহায্যে বসন্ত তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা শুরু করেন ।

মুলুটি গ্রামে রাজা বাজ বসন্ত প্রাসাদ তৈরীর বদলে মন্দির নির্মান করতে বেশী আগ্রহী ছিলেন । রাজার উত্তরাধিকারিদের মধ্যেও এই একই আগ্রহ বিশেষভাবে পরিস্ফটিত হতে দেখা গেছে । এই গ্রামটিতে মোট তৈরী মন্দিরের সংখ্যা বেরে দারায় 108 টি । যার মধ্যে বর্তমানে 72 টি মন্দির অক্ষত আছে, বাকি 36 টি মন্দির অবহেলায় নষ্ঠ হয়েছে । অবসৃষ্ঠ 72 টি মন্দিরে এখনও দ্রাবিড়, নাগারা প্রজাতির মিশ্র শিল্পকর্মের ছাপ পাওয়া যায় । মন্দির গুলি মূলত পোড়ামাটি বা টেরাকোটা কাজের তৈরি, প্রত্যেকটি মন্দির গাত্রেই অলংকৃত আছে রামায়ণ, মহাভারত, দূর্গা, শিব, বিষ্ণু, কালী ইত্যাদির পৌরাণিক কাহিনীসমূহ ।

IMG 20201124 233613
সৌজন্যে নিজস্ব তোলা আলোকচিত্র রাজা বাজ বসন্তের তৈরী মন্ডপ

মুলুটি সংক্রান্ত ঐতিহাসিক আলোচনায় অনেকে আবার বলেন, বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের অঞ্চল মল্লহাটি হিসেবে মুলুটিগ্রামটির নামকরন হয়েছে। অতীতে বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, উত্তরে পাকুড় এবং ছোট নাগপুর মালভূমির কিছু অংশ নিয়ে মল্লভূমী হিসেবে পরিচিত ছিল মল্ল রাজ সাম্রাজ্য। এখনও রামপুরহাঠ থেকে মুলুটি যাওয়ার রাস্তায় ছোট নাগপুর মালভূমি সংলগ্ন ছোট টিলার অংশবিশেষ দূর থেকে দৃশ্যায়িত হয়। অনেক পুরাতত্ত্ববিদ্ র মতে শুঙ্গ বংশের সময় মুলুটির নাম ছিল গুপ্ত কাশী ।

IMG 20201124 233418
সৌজন্যে নিজস্ব তোলা আলোকচিত্র 72 টি মন্দিরের একটি টেরাকোটা মন্দির

বজ্রযান সিদ্ধ বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধকেরাও এখানে আসতেন। তারই সূত্রে মুলুটি গ্রামের মৌলিক্ষ্যা মাতার মন্দিরটি এখনও পুরোনো ঐতিহাসিক নিদর্শনতার সাক্ষী রাখে। পাটলিপুত্রের রাজা এই মুলুটিতে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন বলে শোনা যায়। এও বলা হয় আদি শঙ্করাচার্য কাশী যাওয়ার পথে এখানে থেমেছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী হিন্দু জাগরণ আন্দোলনের সূচনা তিনি এখান থেকেই আরম্ভ করেন। 1857 এ বাঙালি তান্ত্রিক সাধক বামাখ্যাপা মুলুটিতে আসেন। তিনি প্রায় আঠেরো মাস এই গ্রামের মৌলিক্ষ্যা মন্দিরে অবস্থান করেন এবং তিনি এখানেই প্রথম সিদ্ধিলাভ করেন । পরবর্তি সময়ে সাধক বামাখ্যাপা তারাপীঠ মন্দিরটির প্রধ্যান পুরোহিত হিসেবে মায়ের পূজোর ভার গ্রহন করেন । এই অঞ্চলের লোকেরা তাই মৌলিক্ষ্যা মা কে ‘বড় মা’ এবং তারাপীঠের কালী কে ‘ছোটো মা’ বলে অভিহিত করেন । এখানকার বাৎসরিক কালীপুজোয় একশোর অধিক ছাগল বলি দেওয়ার রীতি বহুকাল থেকে প্রচলিত আছে ।

মুলুটি  নিকটবর্তী চিলা নদীর পারে কিছু প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া যায় কিন্তু তারপর এত বছর কেটে গেলেও সরকার আর কোনো খননকার্য সেখানে করিয়ে উঠতে পারেননি । এই চিলা নদীটি দুমকা জেলার মালভূমি থেকে বেরিয়ে ঝাড়খণ্ড ও বাংলার বীরভূম জেলার সীমানা বেয়ে দ্বারকা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই নদীর তীরে বিভিন্ন এলাকায় প্রাগৈতিহাসিক ধারালো সব অস্ত্র, তীড়, প্রস্তর, কুঠার ইত্যাদি পাওয়া গেছে । যাদেখে অনুমান করা যায় এগুলি প্রাচীন প্রস্তর যুগ হতে মধ্য প্রস্তর যুগের সুচনার সময়কালীন। প্রত্নতাত্ত্বিকবিদ্ এর মতানুযায়ী এই নিদর্শন গুলি প্যালিওলিথিক যুগের হতে পারে বলে সম্ভাবনা করা যায়।

IMG 20201124 233635
সৌজন্যে নিজস্ব তোলা আলোকচিত্র অনাদরে পরে থাকা মুলুটি র পোড়ামাটির মন্দির
সৌজন্যে Live History India Aditi Shah

কী ভাবে যাবেন ?

কলকাতা থেকে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ুন গাড়ী নিয়ে, শক্তিগঢ় এ ল্যাংচা দিয়ে ব্রেক ফাস্ট সেরে পৌছে যান রামপুরহাঠ হয়ে 12 টার আগেই পৌছে যান মুলুটি । ঘুরে দেখুন চারপাশ, চাইলে পিকনিক করতে পারেন মৌলিক্ষ্যা মন্দির লাগোয়া মাঠটিতে। রাতের মধ্যে ফিরে আসুন কলকাতা। এখানে বিশেষ ভালো খাওয়া দাওয়া র জায়গা নেই তাই বাড়ী থেকে অথবা রামপুরহাঠ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তু নিয়ে জাওয়াই ভালো । এক রাত্রি থাকতে হলেও আপনাকে ফিরে আসতে হবে রামপুরহাঠ এ। রামপুরহাঠ ছারাও 55 কিলোমিটার দূরেই আছে দুমকা শহড়টি । হাতে আরও একদিন সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন ঝাড়খন্ডের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রস্থল দুমকা থেকে । আপনি ট্রেনে ঘুরে আসতে চাইলে হাওড়া থেকে ট্রেনে রামপুরহাঠ অথবা দুমকা আসতে হবে সেখান থেকে গাড়ী ভাড়া (আন্দাজ প্রতি কিলোমিটার 12 টাকা) করে আসা যাবে মুলুটি

তাহলে আসছে শীতে ঘুরে আসুন এই ছোট্ট সবুজ ঘেরা গ্রামটি থেকে । দূষন,কোলাহল ভীড় থেকে দূরে গুটি কয়েক লোকের বসবাসপূর্ণ এই গ্রামটি নিংসদ্ধেহে মনে দাগ রেখে যাবে।

আজকের প্রচ্ছদটি কেমন লাগলো অতি অবশ্যই লিখে জানান আমাদের কমেন্ট বক্সে ।

আরও পড়ুন:

https://banglakhabor.in/2020/11/25/%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%ad%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%b0-%e0%a6%86%e0%a7%9f%e0%a7%8b%e0%a6%9c%e0%a6%a8/