এই দেশে প্রথম ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে মুম্বাইয়ে, থুড়ি তৎকালীন বোম্বে শহরে। আর বাংলায় প্রথম ট্রেন চলতে শুরু করে ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে হুগলির মধ্যে। সেই শুরু। এরপর দীর্ঘ পথ অতিক্রান্ত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই কলকাতা শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে মফস্বল এমনকি গ্রামের দিকেও রেলপথ সম্প্রসারিত হয়। কেবলমাত্র কলকাতা শহরের নয়, তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার অন্তর্গত ঢাকা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলেও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

স্বাধীনতার পর দেশের সমস্ত বেসরকারি ও রাজ্যগুলির দ্বারা পরিচালিত রেল কোম্পানিগুলিকে জাতীয়করণ করে একই ছাতার তলায় আনা হয়। তারপর সময়ের নিয়ম মেনে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রেলপথের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি ভোল বদলেছে রেলগাড়ি বা ট্রেনের কামরার। ক্রমশ জাতির “লাইফ লাইন” হয়ে উঠেছে ভারতীয় রেল। এর মতো সস্তা এবং যানজটের সমস্যা বিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প কোনো কিছু এখনো পর্যন্ত দেশের সাধারণ মানুষের কাছে নেই। এমনকি যানজটের সমস্যা এড়িয়ে যাতায়াত করার জন্য অনেক পয়সাওয়ালা মানুষ আজও ট্রেনে চাপেন।মানুষের চাহিদা এবং সময়ের নিয়ম মেনে রাজধানী, দুরন্তের মতো প্রিমিয়াম ট্রেন যেমন লাইন ধরে দৌড়ে চলেছে, তেমনি সাধারণ দূরপাল্লার ট্রেন লোকাল ট্রেন‌ও চলছে। সেই সঙ্গে আছে মালগাড়ির দীর্ঘ সর্পিল চেহারা। সেও হেলতে দুলতে এগিয়ে চলে রেল লাইন ধরে। এ যাত্রা চলতেই থাকবে।

images 6 9
Somewhere in Blog

রেলপথ এবং ট্রেনকে ঘিরে কোটি কোটি মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনের সম্পর্ক যেমন জড়িয়ে আছে তেমনি অসংখ্য মানুষের নানা ধরনের স্মৃতি এবং টানাপোড়েনও জড়িয়ে আছে। সেই পঞ্চাশের দশকে “পথের পাঁচালী” সিনেমায় সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছিলেন অপু ও দুর্গার মনে ট্রেন নিয়ে কি অপার বিস্ময়ের ছোঁয়া! নগর সভ্যতায় বসবাস করতে করতে আমাদের মন‌ও ক্রমশ অট্টালিকার ইট কাঠ পাথরের মতো স্পন্দনহীন হয়ে গিয়েছে বোধহয়। তাই আমাদের মনে রেলগাড়ির ঝাঁকুনি বা দ্রুত চলে যাওয়া আর কোনো দোলা দেয় না হয়তো। তা বর্তমানে অনেকের কাছেই শুধু প্রয়োজন, কখনোবা বিরক্তি তৈরীর উপাদানও বটে।

আসলে হবে নাইবা কেন? একে তো জীবন গঠনের ইঁদুর দৌড়ের মাঝে পড়ে আমারা আমাদের প্রাণটাই বোধহয় হারিয়ে ফেলেছি, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রযুক্তির উন্নয়ন। স্টিম ইঞ্জিনের রেলগাড়ি বা কয়লা ট্রেনের বগির যে রোমান্টিসিজম ছিল তা আজকের আধুনিক রেলগাড়িকে দেখে তৈরি না হওয়াই স্বাভাবিক। সে এক সময় ছিল বটে, তখন চারিপাশে এত মানুষ গিজগিজ করতোনা। নগর সভ্যতাও তার সর্বগ্রাসী “হা” নিয়ে এতটাও ঝাঁপিয়ে পড়েনি তখন। তখনো গড়িয়া, মুকুন্দপুর, বাটা, বজ বজ, সোনারপুর, মধ্যমগ্রাম, বেলুড় প্রায় গ্রাম ছিল। তখনো রেল লাইনের ধারে পড়ে থাকতো ধুধু ধান জমি কিংবা জলা। দেখলে মনে হতো মাটির বুক চিরে কি একটা যেন সোজা চলে গিয়েছে। তখনো রেল পথের দু’ধারে শরৎ এর কাশের মেলা বসে যেত।

images 7 9
Toprankers

সেই কাশবনের ফাঁক দিয়ে কেবল অপু-দুর্গা রেলগাড়ি চলে যাওয়া দেখতে যেত তা নয়, দেখতো অসংখ্য অসংখ্য নাম না জানা অপু দুর্গারা। আর তার পরই তাদের মধ্যে তৈরি হতো কল্পনার জাল। যা তারা নিজেদের কল্পনায় নিজের মতো করে বুনে নিতে। রেল গাড়ির ইঞ্জিন থেকে নির্গত হওয়া ধোঁয়ার সাহায্যে কেউ আঁকত তার স্বপ্নের দেশের জলছবি, কেউবা তার কল্পনার ডানা মেলে হারিয়ে যেত নাম না জানা জগতে, ভুলে যেত বাস্তবকে।

শোনা যায় সেই সময় গ্রামের অনেক মানুষ ছিলেন যারা বিকালের ট্রেনের হুইসেল শুনে ঘড়ির সময় মেলাতেন। আসলে তখন এক কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় বাঁধা ছিল এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। অথচ এই নিয়ম তাকে কৃত্রিম করে দিতে পারেনি। তা গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে ছিল না পাওয়া এক হাতছানি। ট্রেনের হুইসেল যেমন অনেকের কাছে সময় জানার মাধ্যম ছিল, তেমনই তার হুইসেলের শব্দতরঙ্গ অনেক কিশোরের মন ছাপিয়ে পরিণত বয়স্ক মানুষের কানে পৌঁছে তাকেও দূর দেশে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।

images 8 11
Wikipedia

যারা সেই সময়কার রেলগাড়ির হুইসেল শুনেছেন তারাই জানেন তার মধ্যে কি তীব্র আবেদন ছিল। কি অসীম ক্ষমতা ছিল মনের ভেতর দোলা লাগিয়ে দেওয়ার! সেই ডাক, হাতছানি যে উপেক্ষা করা খুব একটা সহজ ছিল না! তাহলে কী করতেন তারা? রেলগাড়ির হুইসেল শুনে তবে কি কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধা যেমন ছুটে যেত, তারাও কি নব যুগের রাধার ভূমিকা পালন করতেন? নানা সেরকম কিছু হতো না। ওইটা কেমন যেন  মনকে বড় উদাস করে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারত নাম না জানা কোনো এক অজানা প্রান্তরে। বুকের ভেতরটা যেন কেমন অজানা আপনজনের টানের মোচড়ে কেঁপে উঠতো। শুধু কি তাই, কত মানুষের কাছে সময় ভেধে ঋতুভেদে এই হুইসেলের তাৎপর্য ছিল আলাদা।

গ্রাম বাংলার নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের কাছে জাহাজের ভোঁ’র একটা আলাদা তাৎপর্য আছে। সেই ভোঁ যেন তাদের মনে সাত সমুদ্র তেরো নদীর গল্প বয়ে নিয়ে আসে। তেমনি সময়ভেদে শেষ ট্রেনের হুইসেলের আলাদা তাৎপর্য মানুষের কাছে বরাবরই ছিল, অবশ্যই যাদের বাড়িতে সেই শেষ ধ্বনিটা গিয়ে পৌঁছানো সম্ভব হতো। এখানেই উঠে আসে শীতের রাতের আবেশের কথা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই গ্রাম বাংলা শীতের রাতে সম্পূর্ণ নিঝুম হয়ে যায়। একটা শব্দ শোনা যায় না। তাই সুদূরের রেল স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার সময় যখন হুইসেল দেয়, তখন তা ভাসতে-ভাসতে আমাদের কল্পিত কিশোর মনে নাড়া দিয়ে যায়।

ট্রেন,
Wikipedia

শীতের রাতে মা বাবা যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন কোনো এক কল্পনাপ্রবণ কিশোর-কিশোরী হয়তো ওই হুইসেল ধ্বনি শোনার জন্য অপেক্ষায় বসে আছে‌। আসলে অপেক্ষা নয়, তার কাছে ওই ধ্বনি হাত ধরে জগত চেনানোর হাতছানি। আবার সেই যখন বড় হয়ে ওঠে তখন ওই শীতের রাতের ধ্বনি শুনে সে হয়তো তার ছোটবেলায় খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারে।

শীতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ট্রেন ছাড়ার যে হুইসেল আমাদের কানে ভেসে আসে তা কিন্তু আজও বহমান অনেক জায়গায়। ওই ট্রেনের হুইসেলের কম্পাঙ্ক তখন আর হুইসেল থাকে না, তা আমাদের হাতে ধরে পৌঁছে দেয় সেই ছোটবেলার স্মৃতিতে। তাতে ভর করেই আমরা আবার সুতো বুনতে থাকি অনেক কল্পনার, অনেক স্বপ্নের। বারবার ছুঁয়ে দেখি ফেলে আসা দিনগুলোকে।

মানুষের নিজের জীবন যেরকম প্রয়োজনেই অতিবাহিত হয়, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সুন্দর মুহূর্ত অজান্তে কখন তৈরি হয়ে যায় তা সঠিকভাবে ঠাহর হয়না। তেমনি রেলগাড়ি তার প্রয়োজনে হুইসেল দেয়। অথচ সে তার নিজের অজান্তে কখন যে সংসারের নিত্য জটিলতার আবহে পড়ে ধস্ত মানুষের হাত ধরে তাকে কখন যে সেই ছোটবেলার অপু-দুর্গা হয়ে উঠতে সাহায্য করে, তা সে নিজেই জানে না বোঝেও না। জীবনের সব কিছু বোঝার দরকার নেই বোধহয়। তাইতো আজও আমাদের অনেকের কাছে শীতের রাতের শেষ ট্রেনের হুইসেলের আকর্ষণ একইরকম তীব্র আবেদনময় থেকে গিয়েছে। এটুকু যেন থেকে যায়!