১ মার্চ ১৯৩০ সালে কলকাতায় জন্ম হয় মনু মুখোপাধ্যায়ের। বাবা অমরেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন থিয়েটারের মানুষ। তার ফলে ছোট থেকেই বাড়িতে নাট্যচর্চার আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। পরবর্তীকালে উত্তর কলকাতার রাজা মনীন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পাস করে পেশাদার নাটকের প্রম্পটার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। সুদীর্ঘ ছয় দশকের অভিনয় জীবন কাটিয়ে আজ সকাল ৯:৩০ মিনিটে নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা।

ঝোঁকের বশে পাড়ার দলের নাটকে স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে প্রথম নাটকের প্রেমে পড়ে যান মনু মুখোপাধ্যায়। তার বাবা যুক্ত ছিলেন ক্যালকাটা থিয়েটারের সঙ্গে। তবে তিনি ক্যালকাটা থিয়েটারে যোগ না দিয়ে ১৯৫৭ সালে প্রম্পটার হিসাবে যোগ দেন শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে, পরবর্তীকালে যা বিশ্বরূপা নামে বিখ্যাত হয়। এটি ছিল তার জীবনের প্রথম চাকরি।

তখনকার বাংলা থিয়েটার এখনকার মত ছিল না। সেই সময় ছিল বাণিজ্যিক থিয়েটারের যুগ। তখন নাট্য কোম্পানিগুলির প্রতিটি শো’ই প্রায় হাউসফুল হতো। অভিনেতারা নির্দিষ্ট বেতনের ভিত্তিতে দল গুলিতে অভিনয় করতেন। বিখ্যাত অভিনেতাদের সংলাপ পর্দার আড়াল থেকে প্রতিদিন পাঠ করতে করতে গোটা নাটকটাই প্রায় মুখস্ত হয়ে যেত তার। পরে এক সাক্ষাৎকারে মনু মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন “এভাবে প্রম্পট করতে করতে নাটক মুখস্ত হয়ে যাবার ঘটনাটা আমার পরবর্তী অভিনয় জীবনে অনেক সাহায্য করেছে।”

তখন বিশ্বরূপার বিখ্যাত প্রযোজনা “ক্ষুধা” রমরমিয়ে চলছে। প্রতিটি শো হাউসফুল হচ্ছে। এই রকম পরিস্থিতিতে একটি শো এর সমস্ত টিকিট বিক্রি হয়ে যাবার পর বিখ্যাত অভিনেতা কালি ব্যানার্জি নাটক শুরু হওয়ার আগে এসে পৌঁছাতে পারেননি। এই খবরে বিশ্বরূপা কর্তৃপক্ষের পুরো মাথায় হাত পড়ে যায়। তারা তখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না, এমন সময় তারা জানতে পারল ক্ষুধা নাটকটির প্রতিটি সংলাপ মনু মুখোপাধ্যায়ের মুখস্ত। এই কথা শুনে বিশ্বরূপা কর্তৃপক্ষের যেন ধরে প্রান ফিরে এলো। তারা কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই কালি ব্যানার্জীর চরিত্রটি অভিনয় করার জন্য মনু মুখোপাধ্যায়কে মঞ্চে তুলে দেয়। এর পরবর্তী ঘটনায় বাংলা অভিনয় জগতে ইতিহাসের সৃষ্টি হয়।

মনু মুখোপাধ্যায়ের সেইদিনের অভিনয় দর্শকদের মন এতটাই ছুঁয়ে যায় যে এরপর আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিভিন্ন নাটকে এরপর থেকে চুটিয়ে অভিনয় করতে শুরু করেন তিনি। ষাট-সত্তরের দশকে কলকাতার বিজন থিয়েটার, সুজাতা সদন, স্টার থিয়েটার, রংমহল, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ সহ নানান নাট্যমঞ্চে দাপিয়ে অভিনয় করেন তিনি।

নাটকের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র জগতেও অনায়াসে যাতায়াত ছিল তার। সুদামা দ্য হাফ ম্যান নামে একটি সিনেমায় তিনি প্রথম অভিনয় করেন। যদিও এই সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। তার দ্বিতীয় অভিনীত এবং প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ছিল মৃণাল সেনের “নীল আকাশের নিচে”। ১৯৫৯ সালে নীল আকাশের নিচে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এরপর বাংলা চলচ্চিত্র পায় এক শক্তিশালী পার্শ্ব অভিনেতাকে। তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও কাজ করেন। সত্যজিৎ রায়ের জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমায় তার অভিনীত “মছলি বাবা” চরিত্রটি আজও অনেকের মনে জীবন্ত হয়ে আছে। তিনি তরুণ মজুমদার, বাসু চট্টোপাধ্যায়, প্রভাত দাস এমনকি তরুণ প্রজন্মের নির্দেশক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গেও কাজ করেছেন।

images 18 1
KhaborOnline



বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি যেমন অনেক কালজয়ী চরিত্রে অভিনয় করেছেন তেমনি কৌতুক অভিনেতা হিসাবেও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার “কমিক টাইমিং” ছিল অসামান্য। কৌতুক অভিনয় করার জন্য মনু মুখোপাধ্যায়কে কোনো দিন অহেতুক ভাঁড়ামি করতে হয়নি। পাতালঘর চলচ্চিত্রে তার করা “অপয়া” চরিত্রটি শিশু কিশোরদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু চলচ্চিত্র হলো-

নীল আকাশের নিচে
মর্জিনা আব্দুল্লাহ
মৃগায়া
গণদেবতা
অশনি সংকেত
জয় বাবা ফেলুনাথ
গণশত্রু
দাদার কীর্তি
সাহেব
দামু
পাতালঘর
বাকিটা ব্যক্তিগত  ইত্যাদি।

বড় পর্দায় কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ছোটপর্দা অর্থাৎ টেলিভিশনেও নিয়মিত কাজ করেছেন তিনি। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য দুটি ধারাবাহিক হলো-

মামা ভাগ্নে
বয়েই গেল ।

এছাড়াও অসংখ্য টেলিফিল্মে অভিনয় করেন তিনি। তার সবচেয়ে বড় দক্ষতা ছিল পরিচালকদের চাহিদা অনুযায়ী তিনি অভিনয় করতে পারতেন। তাই তাকে নিয়ে বর্তমান সময়ের পরিচালকরাও স্বাচ্ছন্দে কাজ করেছেন।

বাংলা টেলিভিশনে তার আজীবনের অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জীবনকৃতি সম্মান প্রদান করা হয়।

মনু মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে সমাজের নানা স্তরের মানুষজন তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও শোক ঞ্জাপন করছেন ঘটনাটি শোনার পর থেকেই। মনু বাবুর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে বার্ধক্য জনিত কারণ ছাড়াও তিনি বেশ কিছুদিন ধরে হূদযন্ত্রের নানা সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে কোমরেও কিছু সমস্যা ছিল। আজ সকালে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই বর্ষীয়ান অভিনেতা অসংখ্য অনুরাগীকে ফেলে রেখে চিরবিদায় নেন।