2014 সালের ৫ ডিসেম্বর প্রথম বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন করা হয়। সেই শুরু। তারপর থেকে প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর নিয়ম করে পৃথিবী ব্যাপী বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন করে রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাদ্য এবং কৃষি বিষয়ক সংস্থা। এই দিনটি উপলক্ষে প্রতিটি দেশই পৃথক ভাবে নানান কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।

এবারের স্লোগান ও উদ্দেশ্য

এবারের বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের মূল স্লোগান হলো “মৃত্তিকাকে জীবন্ত রাখুন, মৃত্তিকার জীব বৈচিত্র রক্ষা করুন।” স্লোগান থেকেই বোঝা যাচ্ছে মৃত্তিকার ক্ষয় এবং তার গুনাগুন নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা গভীরভাবে চিন্তিত। মৃত্তিকা অর্থাৎ মাটির যাবতীয় গুণাবলী সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তাতে বসবাসকারী জীবাণু, রাইবোজোম, অনুজীবের ওপর। এরাই নানান জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটিতে অক্সিজেন সহ নানান প্রয়োজনীয় উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। একবার যদি কোনো মাটির এই সমস্ত জীবাণু রাইবোজোমের ক্ষতি হয় তাহলে সেই মাটির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলস্বরূপ সেই মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ে।

images 16 1
Probiotic Solutions

মাটি কেন নষ্ট হয়

চাষের জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, কলকারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত জল, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত কৃষিকাজ ইত্যাদি নানা কারণে মাটির জীব বৈচিত্র নষ্ট হয়ে যায় এবং মাটির ক্ষয় হয়। সাময়িক লাভের কারণে মানুষ অনেক সময়ই ভাবনা চিন্তা না করে না জেনে তার ফসলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করে। কীটনাশকগুলি সাধারণত নানান রাসায়নিক দ্রব্যের সমন্বয়ে প্রস্তুত হয়। তার ফলে শস্য ক্ষেতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করলে তা মৃত্তিকার অভ্যন্তরে গিয়ে পৌঁছবে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। এই সমস্ত রাসায়নিকের মিশ্রণ মাটিতে থাকা জীবাণু ও প্রাণী দের ওপর প্রচন্ড ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। তাতে মাটির গুণাবলী সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়।

তেমনি নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করলে মাটির জমাট ভাব নষ্ট হয়ে যায়। তার ফলে আলগা হয়ে গিয়ে সেগুলি বৃষ্টির জলের সঙ্গে দূরে চলে যায়। এই ঘটনাতেও মাটির বাস্তুতন্ত্র এবং জীব বৈচিত্র একই রকম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

আধুনিক পৃথিবীতে মানুষের সুস্থ-সবল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সঠিক গুণাবলীসম্পন্ন মাটি থাকাটা খুব জরুরী। কারণ মাটির ওপরেই মানুষের সমস্ত অস্তিত্বটা দাঁড়িয়ে আছে। মাটির গুণাগুণ ভালো থাকলে তবেই প্রতিটা মানুষ খেতে পাবে, তবেই এই সমগ্র পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা পাবে।

কেন আজ বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস?

মৃত্তিকা সংরক্ষণ এবং তা নিয়ে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ প্রথম নিয়েছিলেন থাইল্যান্ডের তৎকালীন রাজা ভূমিবল অ্যাদুলাদেজ । তার প্রস্তাব অনুযায়ী মৃত্তিকা বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক সংগঠন ২০০২ সালে প্রথম বছরের একটা দিন মৃত্তিকা দিবস হিসাবে বরাদ্দ করার কথা উল্লেখ করে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ৬৮ তম সাধারণ সভায় এই প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং পরবর্তী বছর থেকেই এই দিনটি পালনের কথা ঘোষণা করা হয়। মৃত্তিকা সংরক্ষণ এবং তা নিয়ে সচেতনতা প্রসারে থাইল্যান্ড রাজ ভুমিবল অ্যাদুলাদেজের ভূমিকার কথা মাথায় রেখে তার জন্মদিন ৫ ডিসেম্বরকেই বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রসংঘ। সেই থেকে প্রতিবছর এই দিনটিতে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন হয়ে আসছে। মৃত্তিকা সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এই দিনটিতে প্রতিবছর ভুমিবল অ্যাদুলাদেজ মৃত্তিকা পুরস্কার দেওয়া হয়।

বাঙালির কাছে মৃত্তিকা

আমরা বাঙালিরা বোধ হয় না জেনেই অনেক আগে থেকে মাটির প্রতি যত্নশীল থেকেছি। কারণ নদী-নালার এই বাংলা গাছপালা ঘেরা প্রকৃতির কোলেই বেড়ে উঠেছে। তার এই বড় প্রিয় গাছগাছালির বেড়ে ওঠার পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা যে ওই বর্ণময় মাটির, তা বাঙালি অনেক আগেই বোধহয় বুঝে গিয়েছিল। তাইতো সে লালমাটির দেশকে যেমন আপন করে নিয়েছে তেমনি ঘন কালো কাদামাটিও তার বড় আপন। আবার ঝুরঝুরে বেলে মাটিকেও সে দূরে ঠেলে দেয়নি। নিজের অজান্তেই বাঙালি মাটির যত্ন নিয়েছে জন্মের পর থেকেই। কারণ মাটি শুধু তার কাছে মাটি নয়, সে তার কাছে মা ! তার এই মৃত্তিকা মাকে অবহেলা করতে অক্ষম বাঙালি বুকে করে আজন্ম রক্ষা করার পণ নিয়ে পথ হেঁটে চলেছে।

কিছু অবাঞ্ছিত মানুষ মাঝেমধ্যেই তার সেই মাকে ক্ষতবিক্ষত করার চেষ্টা করে ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয় তার স্নেহের। তাইতো এই বাংলা আজও শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা। তবে এখানেই থেমে গেলে চলবে না। সতর্ক দৃষ্টি রেখে শুধু এই বাংলায় নয়, সংসারের সর্বত্র তার এই মৃত্তিকা মায়ের প্রতি সমান খেয়াল ও লক্ষ্য রেখে তাকে রক্ষা করতে হবে। এই বোধ চারি পাশে থাকা ভিন্ন জাতিদের মধ্যেও সঞ্চারিত করা চেষ্টায় ব্রতী হতে হবে সবাইকেই।