১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় দফার বিধানসভা ভোট অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম দফার মত দ্বিতীয় দফাতেও মোট ৩০ টি কেন্দ্রে ভোটারদের মতামত নেওয়া হবে। আগামী পাঁচ বছরের জন্য যে বিধানসভা কেন্দ্রগুলির জনপ্রতিনিধি নির্ধারণ করা হবে এই দফাতে, সেগুলি চারটি জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ৯ টি করে বিধানসভা কেন্দ্র, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ৪ টি বিধানসভা কেন্দ্র এবং বাঁকুড়া জেলার ৮ টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হবে ১ এপ্রিল।

এপ্রিল ফুলের দিনে কোন ৩০ জন প্রার্থী বাজিমাত করবে এবং বাকিরা বোকা বনে যাবেন, তা পুরোটাই নির্ভর করছে এই কেন্দ্রগুলির জনতা জনার্দনের ওপর। আমরা বরং এই দফার সবচেয়ে নজরকাড়া ১০ টি বিধানসভা কেন্দ্রের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিই-

নন্দীগ্রাম-
দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে শুধু নয় এবারের বিধানসভা ভোটে রাজ্যের ২৯৪ টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া কেন্দ্র হল নন্দীগ্রাম। বলতে গেলে এবারের বিধানসভা ভোটে পাওয়ার সেন্টারে পরিণত হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এই গ্রামীন বিধানসভা কেন্দ্রটি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর মুখোমুখি লড়াইকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতির পারদ যথেষ্ট চড়েছে। এমনকি রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরে নন্দীগ্রামের এবারের নির্বাচন নজর কেড়ে নিয়েছে সবার। তবে নন্দীগ্রামের ভোট শেষ পর্যন্ত দ্বিমুখী নয়, ত্রিমুখী হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে প্রবলভাবে আলোচনায় উঠে এসেছেন সিপিআই(এম) প্রার্থী মীনাক্ষী মুখার্জি। বৃহস্পতিবার যে প্রবল উত্তেজনার মধ্যে এখানকার ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হবে তা আগাম বলাই যায়।

ময়না-
পূর্ব মেদিনীপুরের আরেকটি বিধানসভা কেন্দ্র ময়না। এবারের নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি রাজ্যবাসীর নজর কেড়ে নিয়েছে ক্রিকেটার অশোক দিন্দার জন্য। পেশাদার ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরে শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে বিজেপিতে যোগদেন দিন্দা। বিজেপি তাকেই এবার ময়না কেন্দ্রের প্রার্থী করেছে। নির্বাচনের শেষ দিনে একদল দুষ্কৃতী হাতে এই প্রাক্তন ক্রিকেটার আক্রান্ত হওয়ায় ময়না আরও বেশি করে রাজ্য রাজনীতির অন্যতম আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। যদিও গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে ভালোমতো ব্যবধানে এগিয়ে ছিল তৃণমূল।

হলদিয়া-
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত শিল্পনগরী হলদিয়া। ২০১৬ সালে তৃণমূলের পক্ষে প্রবল হাওয়া থাকা সত্ত্বেও এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয় সিপিআই(এম) প্রার্থী তাপসী মন্ডল। যদিও গত বছর ১৯ ডিসেম্বর শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে মেদিনীপুরে অমিত শাহ’র সভায় তিনি বিজেপিতে যোগদান করেন। এবারের বিধানসভা ভোটে হলদিয়া কেন্দ্রে সেই তাপসী মন্ডলকেই প্রার্থী করেছে বিজেপি। পাল্টা সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হচ্ছে বিশ্বাসঘাতককে মানুষ চিনে নিক, বামেদের আবার ভোট দিক। এই কেন্দ্রে তৃণমূল‌ও ভালোমতো লড়াইয়ে আছে। সব মিলিয়ে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে হলদিয়া অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

চন্ডীপুর-
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আরেকটি তারকাখচিত বিধানসভা কেন্দ্র হল চন্ডীপুর। এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী করেছে টলিউড অভিনেতা তথা যুব তৃণমূল সহ-সভাপতি সোহম চক্রবর্তীকে। স্বাভাবিকভাবেই এবারের নির্বাচনে এই টলিউড অভিনেতা জন্য চন্ডীপুর কেন্দ্রটি দ্বিতীয় দফার ভোটে অন্যতম আলোচ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

খড়গপুর সদর-
পশ্চিম মেদিনীপুরে এই বিধানসভা কেন্দ্র ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই রাজ্য রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। সেবারে প্রথমবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী তথা রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। গত  পাঁচ বছরে খড়গপুর সাগর বিধানসভা কেন্দ্রের অনেক রাজনৈতিক উত্থান পতনের সাক্ষী থেকেছে দীলিপবাবু লোকসভার সাংসদ হওয়ার পর উপনির্বাচনে এই কেন্দ্রটি বিজেপির হাতছাড়া হয়ে যায়। খড়্গপুর সদর পুনরুদ্ধার করতে বিজেপি এবার প্রার্থী করেছে টলিউড অভিনেতা হিরণকে। এই প্রার্থীর সমর্থনে অমিত শাহ পর্যন্ত এখানে সভা করে গিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় দফার ভোটে অন্যতম নজরকাড়া কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে খড়্গপুর সদর।

নারায়ণগড়-
একসময়ের বাম ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নারায়ণগড় থেকে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে হেরে যান সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। এবারের বিধানসভা ভোটে নারায়ণগড়ের হারানো জমি বামেরা পুনরুদ্ধার করতে পারে কিনা সেটাই দেখার। এই কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী করেছে ডিওয়াইএফআইয়ের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সম্পাদক তাপস সিনহাকে। উল্টোদিকে তৃণমূল প্রার্থী করেছে পিছনের সারিতে চলে যাওয়া সূর্য অট্টকে। এই দুই পুরনো রাজনৈতিক নেতার লড়াই নারায়ণগড়কে দ্বিতীয় দফার ভোটে আলাদা জায়গা করে দিয়েছে।

সবং-
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং কংগ্রেস ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। বলা ভালো মানস ভুঁইয়ার একচ্ছত্র আধিপত্য চলতো এই বিধানসভা কেন্দ্রে। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট জামানাতেও তাকে সবং থেকে পরাজিত করতে পারেনি কেউ। পরবর্তীকালে তিনি তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর রাজ্যসভার সাংসদ হন। সেই প্রথম তৃণমূলের প্রতীকে এখানে জয়লাভ করে কেউ। মানস ভুঁইয়ার সহধর্মিনী গীতারানী ভুঁইয়া উপনির্বাচনে জিতে সবংয়ের বিধায়ক হয়েছিলেন। কিন্তু ২০২১ এর বিধানসভা ভোট যে বড় কঠিন তা প্রমাণ করে দিয়েছে তৃণমূলের পদক্ষেপ। রাজ্যসভার সাংসদ হওয়া সত্ত্বেও মানস ভুঁইয়াকে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করতে বাধ্য হয়েছে জোড়া ফুল শিবির।

ডেবরা-
পশ্চিম মেদনীপুরের ডেবরা কেন্দ্রটিতে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে আইপিএস বনাম আইপিএসের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী করেছে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার হুমায়ুন কবিরকে। অন্যদিকে তৃণমূল বিজেপি প্রার্থী করেছে এই জেলার এক সময়ের দাপুটে পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষকে। এই দুই প্রাক্তন পুলিশকর্তার লড়াই রাজ্যের পরিসর ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।

কেশপুর-
বাম আমলে কেশপুর থেকেই দোর্দণ্ড প্রতাপ সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে পাল্টা দেওয়ার লড়াই শুরু করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্লোগান তুলেছিলেন কেশপুর হবে সিপিএমের শেষপুর। এখানকার তৃণমূল বিধায়ক শিউলি সাহাকে আবার প্রার্থী করেছে জোড়া ফুল শিবির। যদিও তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর হঠাৎ করেই গুজব ছড়ায় মুকুল রায় ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শিউলি সাহা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বিবৃতি দিয়ে শিউলি সাহা জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি তৃণমূলেই আছেন। বারবার রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে খবরের শিরোনামে উঠে আসার কেশপুরের ভোট এবারের নির্বাচনে অন্যতম আলোচিত কেন্দ্র হিসেবে থেকে গিয়েছে।

বাঁকুড়া-
বাঁকুড়া জেলার বাঁকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রেটি তৃণমূলের বরাবরের কঠিন ঠাঁই। ২০১৬ সালের প্রবল মমতা হাওয়াতেও এই কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন শম্পা দরিপা। পরবর্তীকালে তিনি তৃণমূলে যোগদান করেন। যদিও এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তাকে প্রার্থীর না করে বাঁকুড়া জয়ের লক্ষ্যে তৃণমূল ভরসা রেখেছে টলিউড অভিনেত্রী সায়ন্তিকা চট্টোপাধ্যায়ের ওপর। মুনমুন সেনের পর এমনিতেই আর তারকা প্রার্থীদের ওপর আস্থা রাখতে চাইছে না বাঁকুড়া, এমন একটা কথা বেশ কিছুদিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই এই কেন্দ্রে সায়ন্তিকার লড়াই খুব একটা সহজ নয়। তবুও তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং এই তারকা প্রার্থীর কারণে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে অন্যতম আলোচ্য কেন্দ্র বাঁকুড়া।